Lawyer: ম্যারিটাল রেপ, ধর্ষণ ও যৌন নিগ্রহ আইন ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারনা

 ম্যারিটাল রেপ, ধর্ষণ ও যৌন নিগ্রহ আইন ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারনা


অ্যাবিউস, আইন ও অধিকার:

শারীরিক বা মানসিক, যে কোনও ধরনের হেনস্থাই আইনের চোখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং সুবিচার পাওয়াও প্রত্যেকের প্রাথমিক সামাজিক অধিকার। কোন ধরনের সমস্যায় কী কী আইনি পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব, সেই সংক্রান্ত পরামর্শ দিলেন আইনজীবী পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়।

কর্মক্ষেত্রে হেনস্থা, গার্হস্থ্য হিংসা, যৌন নিগ্রহ, মানসিক অত্যাচার... একজন সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষের মনের উপর কোনওটারই প্রভাব কম নয়। এই ধরনের ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে ঘটতে থাকলে ব্যক্তির শরীর-মনে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। মহিলারা তো বটেই, এমনকী পরিস্থিতিবিশেষে শিশু, বিশেষভাবে সক্ষম মানুষ বা প্রবীণরাও বিভিন্ন ধরনের হেনস্থার শিকার হন, যা থেকে তাঁদের একার পক্ষে বেরিয়ে আসা রীতিমতো কঠিন। এসব ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করা বা মনের জোরে পরিস্থিতির মোকাবিলা করার প্রয়োজন তো রয়েইছে, তবে আরও বেশি জরুরি হল সঠিক সময়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সমাজে এখনও এই সংক্রান্ত সচেতনতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। ভারতীয় আইনবিধিতে শারীরিক নির্যাতন তো বটেই, এমনকী মানসিক অত্যাচার বা বুলিংয়ের মতো আপাতসাধারণ ঘটনাও যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, অনেকেই তা জানেন না। জানলেও নানা কারণে আইনি ঝামেলায় জড়াতে চান না। এতে অপরাধীও আইনের হাত থেকে বেঁচে যান এবং তার অপরাধপ্রবণতাও বেড়ে যায়। সচেতনতার প্রয়োজন মূলত এখানেই। আইনে কোন অপরাধের জন্য কী ধরনের শাস্তির পরিসর রয়েছে, বা কোনক্ষেত্রে অভিযোগ জানানো যেতে পারে, সেই বিষয়ে প্রত্যেকেরই অন্তত একটা প্রাথমিক ধারণা থাকা উচিত।

ম্যারিটাল রেপ, ধর্ষণ ও যৌন নিগ্রহ:

সুপ্রিম কোর্টের বিচার অনুসারে, যদি কোনও মহিলা ম্যারিটাল রেপের অভিযোগ করেন, সেক্ষেত্রে তাঁর বয়ানও আইনের চোখে একটি প্রমাণ। কারণ, সমাজ যতই এগিয়ে থাকুক, এই সংক্রান্ত স্টিগমা এখনও সমাজে প্রকট। ফলে একজন মহিলা নিজের সম্পর্কে এই ধরনের গুরুতর মিথ্যা বলবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া যেখানে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সুসম্পর্ক নেই, সেখানে স্বাভাবিক সহবাসের সম্ভাবনাও প্রায় থাকে না। ফলে কোনও মহিলা যদি স্বামীর বিরুদ্ধে বলপূর্বক সহবাসের অভিযোগ তোলেন, সেক্ষেত্রে তার বয়ানের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয় হয়। তবে সেই সঙ্গে অবস্থাগত প্রমাণ বা সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্সেরও এসব ক্ষেত্রে খুব বড় ভূমিকা থাকে। যে সমস্ত নিযার্তনের ঘটনা সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্ট করা হয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে মেডিক্যাল টেস্টের মাধ্যমে প্রমাণ জোগাড় করা সম্ভব। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায়, এই ধরনের ঘটনায় অনেক পরে অভিযোগ দায়ের করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে মেডিক্যাল রিপোর্টে ধর্ষণ চিহ্নিত করা বা অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করা কঠিন হয়ে যায়। ফলে সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্সই তখন বিচারের একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে দোষ প্রমাণিত হলে, আইপিসি ৩৭৬ নম্বর ধারা অনুসারে, ১০ বছরের কারাবাস দেওয়া হয়। কোর্ট যদি একে ‘হিনাস ক্রাইম’ হিসেবে চিহ্নিত করে সেক্ষেত্রে অভিযুক্তের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এমনকী ফাঁসিও হতে পারে। ‘নির্ভয়া’ কাণ্ডের পর ৩৭৬ ধারায় বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। মূলত ধর্ষণকে আরও বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে অপরাধের আওতায় আনা হয়েছে এবং সেই অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই ধরনের সংবেদনশীল কেসের জন্য ফাস্টট্র্যাক কোর্টেরও ব্যবস্থা রয়েছে, যাতে দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি করা যায়। অভিযুক্ত যদি নাবালক হয়, সেক্ষেত্রে জুভেনাইল জাস্টিস অনুসারে তার শাস্তির বিচার করা হয়। এর বাইরে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের (বয়স ১৮ বছরের বেশি) সকলের জন্য শাস্তিব্যবস্থা একই। ধর্ষণ ছাড়া অন্যান্য যৌন নিগ্রহের শাস্তি অপরাধভেদে ভিন্ন। ইন্ডিয়ান পেনাল কোর্টে সব ধরনের যৌন নিগ্রহের বিরুদ্ধেই শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। আইপিসি ৩৫৪ এবং পোক্সো ধারা অনুসারে, দোষীর জরিমানা কিংবা কয়েক বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।

শেষে, এই প্রসঙ্গে একটাই কথা বলব। শুধুমাত্র ধর্ষণ নয়, যে কোনও যৌন বা শারীরিক নিগ্রহের ঘটনার ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি, অভিযোগ জানাতে ভিক্টিমরা অনেক দেরি করে ফেলেন। অনেকক্ষেত্রে অভিযোগ করেনই না এবং তার মূল কারণ আমাদের সমাজব্যবস্থা। সমাজের চোখে ছোট হয়ে যাওয়ার ভয়ে অনেকেই নিগৃহীত হয়েও প্রতিবাদ করেন না। অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝেছি, মহিলা বা নাবালিকারা তাদের পরিবার বা চেনা মানুষদের দ্বারাই সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত বা নিগৃহীত হন এবং লোকলজ্জার ভয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা প্রকাশ্যে আনেন না। পরিবারের তরফ থেকেও এই ধরনের ঘটনা চেপে যাওয়া হয় এখনও। মনে রাখতে হবে, আইনে সব অপরাধেরই শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। তবে সুবিচার তখনই পাওয়া সম্ভব, যখন অপরাধ নথিভুক্ত করা হবে বা আইনি সাহায্য নেওয়া হবে। তাছাড়া এ ধরনের অপরাধ চেপে যাওয়ার অর্থ একভাবে অপরাধীদের প্রশ্রয় দেওয়া। একথা ঠিক যে, শাস্তির পরিসর থাকলেও কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। এদেশে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ দায়ের করা যেমন একটা প্রধান সমস্যা, তেমনই অভিযোগ জানানোর পরিকাঠামোতেও বেশ কিছু ত্রুটি রয়েছে। আইনে একটি প্রবাদই রয়েছে, ‘জাস্টিস ডিলেড ইজ় জাস্টিস ডিনায়েড’। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একথাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অনেকক্ষেত্রে তদন্তে গাফিলতি দেখা যায়। আইন অনুসারে, প্রত্যেক এলাকায় অন্তত একটি মহিলা-থানা উচিত, যাতে কোনও মহিলা সমস্যায় পড়লে মহিলা-অফিসারের সঙ্গে নিঃসঙ্কোচে কথা বলতে পারেন। কিন্তু এখনও এদেশে সেই পরিকাঠামো নেই। মেডিক্যাল পরীক্ষাও অন্যতম প্রধান সমস্যার জায়গা। অনেকসময়ই এই ধরনের পরীক্ষায় ত্রুটি থেকে যাওয়ার কারণে তদন্ত দীর্ঘদিন আটকে থাকে। এও কিন্তু নিগৃহিতদের বাড়তি হয়রানি। তাছাড়া একজন নিগৃহীতা সুবিচারের আশায় আইনি পথে এগিয়ে যদি পরিবর্তে দুর্ব্যবহারের শিকার হন, তাহলে তা স্বাভাবিকভাবেই গোটা আইনশৃঙ্খলব্যবস্থাকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দেয়। তবে এই ধরনের অসুবিধা থাকলেও সুবিচার যে পাওয়া যায় না, তা নয়। তাই আইনের উপর থেকে আস্থা হারালে চলবে না। নাহলে যৌন নিগ্রহের ঘটনা কোনওদিনই পুরোপুরি আটকানো সম্ভব হবে না।

গার্হস্থ্য হিংসা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন:

২০০৫ সালে এদেশে ‘প্রোটেকশন অফ উইমেন ফ্রম ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স’ অ্যাক্ট প্রণয়ন করা হয়। এই আইন অনুসারে, একজন মহিলা (বিবাহিত বা অবিবাহিত) যদি পরিবার বা পরিজনদের দ্বারা শারীরিক অথবা মানসিকভাবে নির্যাতিত হন, সেক্ষেত্রে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। গায়ে হাত তোলা থেকে পণের জন্য চাপ দেওয়া বা কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য মানসিক অথবা শারীরিক নির্যাতন, সবই এই আইনের আওতায় পড়ে। তবে পণ সংক্রান্ত নির্যাতনের ক্ষেত্রে আইপিসি সেকশন ৪৯৮-এ দ্বারাও অভিযোগ করা যেতে পারে। এধরনের ঘটনা ঘটলে যে কোনও মহিলাই নিকটবর্তী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ জানাতে পারেন। এর জন্য প্রত্যেক ডিভিশনে একজন করে প্রোটেকশন অফিসার নিয়োগ করা রয়েছে। তাঁর কাছে গিয়েও অপরাধীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানো যেতে পারে। এই বিষয়ে কোনও আইনি সহায়তার প্রয়োজন হলে, প্রত্যেক জেলায় ‘লিগাল সার্ভিস অথরিটি’ থেকে লিগাল এড সার্ভিসের ব্যবস্থা রয়েছে। এর মাধ্যমে মহিলা এবং শিশু বিনামূল্যে আইনি সাহায্য পেতে পারেন। ভিক্টিম আবেদন করলে অথরিটির তরফ থেকেই আইনজীবী নিয়োগ করে দেওয়া হয়। তাঁর পরামর্শে খুব সহজেই অভিযোগকারী আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন। যদিও এই ধরনের সমস্যা আটকানোর জন্য শুধু ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্টই যথেষ্ট নয়। সমস্যার গাম্ভীর্য অনুযায়ী কিছুক্ষেত্রে নির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। এই মুহূর্তে গার্হস্থ্য হিংসার অপরাধে দোষীর সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে কারাবাস হতে পারে। কিছুক্ষেত্রে জরিমানার ব্যবস্থাও রয়েছে। কিন্তু এই আইন মূলত প্রণয়ন করা হয়েছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে তোলার জন্য। এটি ‘কোয়াসি-সিভিল প্রসিজর’-এর আওতায় পড়ে। অর্থাৎ এই আইনে, দোষীকে শাস্তি দেওয়া নয়, বরং সমস্যার মীমাংসা করে অভিযোগকারীকে রিলিফ দেওয়াই মূল লক্ষ্য। ফলে এই আইনে অভিযোগকারী মেনটেন্যান্স ফি বা ক্ষতিপূরণ দাবী করতে পারেন। এছাড়া রেসিডেন্স অ্যাকোমোডেশনেরও ব্যবস্থা রয়েছে, যার মাধ্যমে মহিলা বাসস্থান বা ভাড়া দাবী করতে পারেন।

যদিও এখন শুধু মহিলারাই যে গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হন, তা নয়। আজকাল পুরুষরাও অনেকসময় এই ধরনের ঘটনার শিকার হন। তবে এদেশের আইনে বা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্টে এখনও অবধি পুরুষদের উপর হওয়া শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের জন্য কোনও শাস্তির ব্যবস্থা নেই। এই ধরনের ঘটনা সাধারণ অপরাধের আওতায় পড়ে। অর্থাৎ, কোনও পুরুষের সঙ্গে এধরনের কোনও ঘটনা ঘটলে আইপিসি-র অন্যান্য ধারায় অভিযোগ করা যেতে পারে। যেমন, শারীরিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে আইপিসি সেকশন ৩২৩ (চড় মারা) বা ৩২৫ (গুরুতর শারীরিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে)-এ অভিযোগ দায়ের করা যেতে পারে।

কর্মক্ষেত্রে যৌন নিগ্রহ, অ্যাবিউস কিংবা হ্যারাসমেন্ট:

কর্মক্ষেত্রে যদি কেউ সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের শিকার হন বা মেন্টালি অ্যাবিউসড হন, তার জন্য নির্দিষ্ট আইনব্যবস্থা রয়েছে। ‘সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট অফ উইমেন অ্যাট ওয়র্কপ্লেস’-এর আওতায় প্রিভেনশন, প্রহিবিশন এবং রিড্রেসাল অ্যাক্ট রয়েছে, যা ২০১৩ সালে পাশ হয়। এই আইন অনুসারে, প্রতিটি অফিসে একটি করে এনকোয়ারি কমিটি থাকা বাধ্যতামূলক। এই ধরনের কোনও ঘটনা ঘটলে সরাসরি সেই কমিটির কাছে রিপোর্ট করা যেতে পারে। শুধু তাই নয়, এই আইনের নির্দেশ অনুসারে, যদি কোনও মহিলা কর্মক্ষেত্রে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের অভিযোগ জানান, সেক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ এনকোয়ারি কমিটিকে তদন্ত শুরু করতে হবে এবং প্রমাণ পেলে সঙ্গে সঙ্গে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। শাস্তি পুরোটাই নির্ভর করবে অপরাধের গাম্ভীর্যের উপর। উইদাউট পে লিভ বা সাময়িক বরখাস্ত থেকে জটিলতর সমস্যার ক্ষেত্রে টারমিনেশনও করা যেতে পারে। আপাতত মহিলারাই এই অ্যাক্টে অভিযোগ করতে পারেন। তবে পুরুষদের ক্ষেত্রেও তো এখন কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার ঘটনা বিরল নয়। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনও আইন এখনও অবধি নেই। কোনও পুরুষ যদি যৌন হেনস্থার শিকার হয়ে আইনের সাহায্য চান, তা হলে সেগুলো অ্যাবনর্মাল সিচুয়েশনের আওতায় আসবে।

শিশুদের অ্যাবিউস:

অ্যাবিউসের হাত থেকে অনেক সময় ছোটরাও রেহাই পায় না। বাড়িতে অতিরিক্ত মারধর বা স্কুলে শারীরিক নিগ্রহের শিকার হয়েছে শিশুরা— এমন উদাহরণ অনেক রয়েছে। তবে শিশুর উন্নতিকল্পে যদি তাকে অল্পবিস্তর শাসন করা হয়, আইনের চোখে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না। কিন্তু যদি শাসনের নামে নিগ্রহ হয়ে ওঠে ব্যাপারটা, তখন তাকে ভারতীয় দণ্ডবিধির (আইপিসি) আওতাতেই ফেলা হবে। ৩২৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী স্বেচ্ছায় কাউকে আঘাত করার শাস্তি হিসেবে এক বছর পর্যন্ত জেল এবং/অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। ৩২৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী, যদি বিপজ্জনক কোনও অস্ত্র দিয়ে অথবা বিপজ্জনক উপায়ে কাউকে আঘাত করা হয়, তা হলেও জেল ও জরিমানা হতে পারে। ৩২৫ নম্বর ধারার আওতাতেও জেল ও জরিমানা হতে পারে, যদি কাউকে অত্যন্ত গুরুতরভাবে আঘাত করার দায়ে কেউ দোষী সাব্যস্ত হয়। এবং শিশুদের আঘাত করা হলে এই সবকটি ধারাতেই শাস্তি হতে পারে।

বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েরা অথবা যাদের ইয়ং-অ্যাডাল্ট বলা হয়, তাদের জীবনে বিভিন্ন কারণে নানা জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। অনেক সময় একে অপরের সঙ্গে নানা সমস্যায় জড়িয়ে পড়তে পারে তারা। যার ফলে হাতাহাতি, শারীরিক আঘাত বা অন্য কোনও ধরনের অ্যাবিউস একজনের উপর করতে পারে অন্যজন।এক্ষেত্রে অভিযুক্তর বয়স যদি ১৮ বছরের কম হয়, তা হলে সেই মামলা আসবে জুভেনাইল জাস্টিসের আওতায়। অর্থাৎ, অভিযুক্তকে শাস্তি দেওয়া নয়, তাকে সংশোধন করাই হবে লক্ষ।

বিশেষ মানুষদের জন্য:

শারীরিক, মানসিক অথবা বৌদ্ধিক দিক থেকে যারা বিশেষভাবে সক্ষম, তা সে বড়ই হোন বা ছোট কেউ— তাদের সঙ্গে অনেকসময় বড় নির্মম আচরণ করে আশপাশের মানুষেরা। শারীরিক নিগ্রহ বা মানসিক নির্যাতন, সবেরই শিকার হতে হয় তাদের। তার জন্য অ্যাবিউসের জন্য নির্দিষ্ট যে আইন, তার আওতাতেই শাস্তি পেতে পারে দোষীরা। তবে ২০১৭ সালে বলবৎ হয়েছে ‘রাইট অফ পার্সনস উইথ ডিজ়েবিলিটিস অ্যাক্ট ২০১৬’। বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের অধিকার কোনওভাবে খর্ব যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করতেই এই আইন। সেখানে কিছু প্রভিশন রয়েছে, যার ফলে তাঁদের সঙ্গে কোনও অন্যায় আচরণ করা হলে শাস্তি হতে পারে। তবে সব ধরনের অন্যায় বা অত্যাচার যে এই আইনের আওতায় পড়ছে, এমন নয়। সেক্ষেত্রে দোষ প্রমাণ হলে ভারতীয় দণ্ডবিধির নির্দিষ্ট ধারা অনুযায়ীই শাস্তি হবে।

সাইবার অ্যাবিউস:

সোশ্যাল মিডিয়ায় কাউকে গালমন্দ করা, ‘বুলি’ করা, ‘মিম’ বানিয়ে কাউকে হেনস্থা করা, ট্রোলিং... এ সব এখন ঘণ্টায়-ঘণ্টায় ঘটে। যারা এই ধরনের অ্যাবিউসের শিকার হন, তাঁদের মনের উপর এর গভীর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আমাদের দেশে যে ‘ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যাক্ট’ রয়েছে, তার অ্যামেন্ডমেন্ট হয়েছিল ২০১০ সালে। যে কোনও ধরনের সাইবার ক্রাইম— বুলিং, স্টকিংয়ের মতো অ্যাবিউস হোক বা টাকা হাতিয়ে নেওয়া— সেই অপরাধকে চিহ্নিত করে দোষীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য সেই অ্যাক্ট যে যথেষ্ট নয়, এ কথা অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই। তদন্তের ক্ষেত্রেও অনেক রকমের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। আমাদের দেশে যাঁরা সাইবার ইনভেস্টিগেশন যাঁরা করেন, তাঁরা আইটি এক্সপার্ট নন। কিন্তু এই ধরনের অপরাধের তদন্ত করতে হলে তথ্যপ্রযুক্তির কিছুটা জ্ঞান থাকা আবশ্যিক। কিন্তু আমাদের আইনে কোনও প্রভিশন নেই যে সাইবার অ্যাবিউস বা ক্রাইমের তদন্ত যিনি করবেন তাঁর আইটি-র জ্ঞান থাকা বাধ্যতামূলক। দ্বিতীয়ত, সোশ্যাল মিডিয়ায় অ্যাবিউস করার চেয়ে বড় সুবিধা আর নেই। মেঘনাদের মতোই আড়াল থেকে যা খুশি তাই করতে পারে এরা। পুলিশের কাছে গেলে তারা অপরাধীর আইপি অ্যাড্রেস পেতে পারে বড়জোর। ঠিকানা বা অন্য তথ্য ছেড়েই দিন, নামটাও আসল কি না, সেখান থেকে বোঝা সম্ভব নয়। তখন নির্দিষ্ট যে সংস্থা— সে ফেসবুক হোক, গুগল হোক বা অন্য কেউ— তাদের শরণাপন্ন হতে হয় ডেটা উদ্ধার করতে। এবং অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ সেটা পেরে ওঠে না। কারণ এদের ডেটা প্রোটেকশনের নিজস্ব পলিসি রয়েছে।

এবার প্রশ্ন হল, কেউ যদি সাইবার অ্যাবিউসের অভিযোগ নিয়ে আইনের দ্বারস্থ হন, তা হলে কতখানি সাহায্য তিনি পাবেন। এর আগে কম্পি‌উটার অথবা অন্য কোনও যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ কাউকে ‘কুরুচিকর’ বা ‘ভীতিকর’ কোনও তথ্য পাঠালে, ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যাক্টের ৬৬এ ধারায় তার শাস্তির ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু এই ধারাকে বাতিল করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। ফলে এই ধরনের অপরাধের যোগ্য শাস্তির ব্যবস্থা করার মতো আইনই আপাতত নেই। ২০১০ সালে যে অ্যামেন্ডমেন্ট হয়েছিল, তার পরেও ‘সাইবার অ্যাবিউস’এর বিরুদ্ধে কোনও নির্দিষ্ট প্রভিশন যোগ করা হয়নি। সাধারণ আইনেই শাস্তি হতে পারে— কারাদণ্ড এবং/অথবা জরিমানা।

বয়স্কদের হেনস্থা:

বয়স্কদের যে কোনও ধরনের অ্যাবিউসের ক্ষেত্রে তাঁরা সিনিয়র সিটিজ়েন’স অ্যাক্ট-এর সাহায্য নিতে পারেন। শারীরিক হেনস্থা, মানসিক অথবা সামাজিক নির্যাতন— যে কোনও অ্যাবিউসেরই শাস্তি দেওয়ার জন্য এই অ্যাক্ট প্রযোজ্য। তবে শাস্তির চেয়ে এই অ্যাক্টের উদ্দেশ্য হল বয়স্ক মানুষের হেনস্থা থেকে মুক্তি ঘটানো। যেমন যদি সন্তান তাঁর বয়স্ক বাবা-মায়ের খরচ না দেন অথবা দিতে অপারগ হন, তাঁদের খরচ চালানোর ব্যবস্থা রয়েছে এই অ্যাক্টে। যদি বয়স্ক কাউকে দিয়ে জোর করে সম্পত্তি লিখিয়ে নেওয়া হয়, সেই সম্পত্তি তাঁদের ফেরত পাইয়ে দেওয়া রয়েছে। এই ধরনের কোনও অভিযোগ যদি আনা হয়, তা ক্রিমিনাল কেসের আওতায় পড়ে। এর কোনও সিভিল জুরিসডিকশন নেই।

অ্যাবিউসের বিরুদ্ধে যে সব আইন রয়েছে, সেগুলোর অপব্যবহারও হতেই পারে... অর্থাৎ মিথ্যে অভিযোগ বা সাজানো মামলা। এমন কিছু যদি প্রমাণ হয়, তা হলে ভারতীয় দণ্ডবিধির ২২ নম্বর ধারায় ‘পানিশমেন্ট ফর ফল্‌স কমপ্লেন অর ফল্‌স ইনফরমেশন’এর প্রভিশন রয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে ৬ মাসের কারাদণ্ড এবং/অথবা জরিমানা হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে এই ৬ মাসটা এক বছরও হতে পারে।

শেষে একটা কথা বলতেই হয়। অ্যাবিউস আমাদের সমাজে যতটা হয়, তা প্রশাসনের গোচরে আনার নিদর্শন কিন্তু ততটা হয় না। এর জন্য আক্রান্তের সচেতনতা যেমন দরকার, তেমনই প্রশাসন ও সমাজের তরফেও দরকার তাঁদের পাশে দাঁড়ানো। অর্থাৎ, কেউ যদি আক্রান্ত হন, তিনি প্রশাসনের এবং আইনের দ্বারস্থ হলে তার জন্য তাঁকে হেনস্থা হতে হবে না— এইটুকু সুনিশ্চিত করা। বহু অত্যাচারের ঘটনা ঘটে, যেখানে আক্রান্তেরা অভিযোগ করতেই ভয় পান— শুধুমাত্র এই জন্য, যে যদি তারপর তাঁর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় অথবা তাঁকে আরও হেনস্থার মুখে পড়তে হয়। এই সংশয় যতদিন মানুষের মনে থাকবে, ততদিন অ্যাবিউসের বিরুদ্ধে যে আইনই আনা হোক, তা একশো শতাংশ কার্যকর হয়েছে— এ কথা বলা যাবে না। আইন থেকে যাবে কাগজে-কলমেই, যদি একজন মানুষও তার সুবিধা পেতে অপারগ হন। তাই সকলের আগে জরুরি, প্রতিটি আক্রান্তের মন থেকে সব ভয় মুছে যাওয়া— যাতে অত্যাচারের মুখে পড়লে তিনি গুটিয়ে না গিয়ে, অত্যাচারীকে যোগ্য শাস্তি দিতে আইনকে সাহায্য করতে পারেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url