Proper management of students: ছাত্রদেরকে সঠিক পরিচালনা করা এবং অভিভাবকদের করণীয় কর্তব্য
ছাত্রদেরকে সঠিক পরিচালনা করা এবং অভিভাবকদের করণীয় কর্তব্য
কেরিয়ার অবসেশন:
আর সব পড়ে থাক, লোভনীয় কেরিয়ারই একমাত্র মোক্ষ! টিনএজারদের এই কেরিয়ার অবসেশন নিয়ে কথা বললেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, ডা. আবির মুখোপাধ্যায়।
বাচ্চারা পড়তে চাইছে না, মা-বাবা তাদের উপর হেলিকপ্টার পেরেন্টিং চালাচ্ছেন– এই সমস্যাটা চেনা। কিন্তু উল্টো পিঠও রয়েছে সমস্যার... যখন ছেলেমেয়েরা শুধুই পড়ার বইয়ে মুখ গুঁজে থাকে, বাড়ির চাপ না থাকলেও। এর দু’ধরনের প্রেক্ষিত থাকতে পারে। প্রথমটা হল নম্বর পাওয়া নিয়ে অবসেশন... এত নম্বর, এত পার্সেন্ট পেতেই হবে, অমুককে হারিয়ে দিতেই হবে। ফলে সহপাঠীদের সঙ্গেও সুস্থ সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। আর দ্বিতীয় প্রেক্ষিতটা হল আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়– কেরিয়ার অবসেশন, যা এখন অনেক বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়ের মধ্যেই দেখা যায়।
কেরিয়ার অবসেশন কেন?
অনেক বাচ্চাই একটু বড় হওয়ার পর বুঝতে পারে তার দক্ষতা কোন দিকে, ঝোঁক কোন দিকে। এবং সেই অনুযায়ীই কেরিয়ার বাছতে চায়। সেখানে কোনও অবসেশনের প্রশ্ন থাকে না। অবসেশন হয় তখনই, যখন তারা কেরিয়ারের সঙ্গে রোজগারকে এক করে দেখতে শুরু করে। এবং এই ভাবনাচিন্তা বা এক্সপোজ়ারগুলো সাধারণত শুরু হয় টিন-এজেই। সোশ্যাল মিডিয়া থেকেই তারা জেনে যায়, অমুকের স্যালারি এত, পার্কস এই... অতএব ওই পেশাতেই যেতে হবে তাদেরও! এই বয়সের মধ্যে অমুক মডেলের গাড়িটা কিনবে, এই বয়সে ফ্ল্যাট কিনবে, জাগতিক সুখের নানা উপাদানে জীবন ভরিয়ে তুলবে বলে কেরিয়ারকেই জীবনের একমাত্র মোক্ষ বানিয়ে নেয় এরা। তার বাইরের পৃথিবীটা থাকে অদেখা। কিন্তু এটা তাদের মাথায় থাকে না যে, অমুক পেশা মানেই এত মাইনে... ব্যাপারটা এভাবে ছকে ফেলা যায় না। দক্ষতা, পরিশ্রম, সময়, সুযোগ... সব কিছু মিলিয়ে একটা মানুষের কেরিয়ার তৈরি হয় ধীরে ধীরে। সচিন তেণ্ডুলকরও এই উচ্চতায় পৌঁছবেন ভেবে খেলা শুরু করেননি। খেলতে নেমে রাস্তা তৈরি করেছেন।
ক্ষতি কী কী?
যারা মার্কসের পিছনে ছোটে এবং যারা মোটা মাইনের পিছনে– দুই দলই এই ছোটার চক্করে সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বন্ধু আর হয় না তাদের, সকলেই হয়ে ওঠে প্রতিযোগী। ফলে ছাত্রজীবনের যেটা সবচেয়ে সুন্দর দিক– বন্ধু তৈরি করা, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো– তার স্বাদ এরা পায় না বললেই চলে। পাড়ায় বিকেলে খেলতে বেরোনো, স্কুলে ফাংশন করা, শীতকালে পিকনিকে যাওয়া, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক রাখা– এই অভিজ্ঞতাগুলো হয় না বলে এদের কোনও সোশ্যাল স্কিলও তৈরি হয় না। এরা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, যার প্রভাব কিন্তু ভবিষ্যতে শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, কর্মজীবনেও পড়ে। খুব কম পেশাই রয়েছে, যেখানে একদম এককভাবে, কারও সঙ্গে কো-অর্ডিনেট না করেই কাজ চালানো যায়। বেশিরভাগ পেশাতেই সফলভাবে কোনও কাজ করার অন্যতম মন্ত্র হল, সঠিক কো-অর্ডিনেশন... কার সঙ্গে কীভাবে কমিউনিকেট করলে কাজটা ঠিক হবে, সেটা বোঝা এবং সেই অনুযায়ী চলা। যারা ছোট থেকেই সেভাবে সামাজিক হতেই শেখেনি, স্বাভাবিকভাবেই এখানে তারা মার খেয়ে যায়।
ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষতিও কম নয়। কারও সঙ্গে মিশতে শেখে না বলে এদের মধ্যে অদ্ভুত এক স্বার্থপরতা তৈরি হয়। যে ইঁদুর দৌড়ে এরা নাম লিখিয়ে ফেলে, সেখানে অন্যকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে ছুটে চলা ছাড়া গতি নেই। ফলে সহমর্মিতা, সংবেদনশীলতার মতো বোধগুলো তৈরি হয় না এদের। আমাদের মস্তিষ্কের কোন দিকগুলো বিকশিত হবে, সেটা নির্ভর করে আমাদের এনভায়রনমেন্টাল ইন্টার-অ্যাকশনের উপর। সেগুলোকে যদি কেউ একটা নির্দিষ্ট দিকেই চালনা করি এবং সেই দিকটাও হয় নিজের উপর চাপানো– তাহলে তো সে অ্যাসোশাল হয়ে যাবেই!
বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন অন্যান্য স্কিল বা দক্ষতাও থাকে... গান, আঁকা, খেলাধুলো, গার্ডেনিং, বেকিং, কত কী! সেগুলো রোজগারের রাস্তা তো হতেই পারে, তা ছাড়াও হতে পারে মানসিক বিকাশের সহায়ক। ‘এ সব করে তো আর ব্যাঙ্ক-ব্যালান্স হবে না’ ভেবে যারা এগুলোকে সরিয়ে রেখে দেয়, তারা জানেও না যে, মনে কতটা আলো-বাতাস খেলার পথ নিজেরাই বন্ধ করে দিল!
টাকা-বাড়ি-গাড়ির পিছনে একভাবে ছুটে চললে সময়ের অনেক আগেই শরীর-মন-মাথার গ্রহণক্ষমতা কমে আসবে– যাকে বলে ‘বার্ন আউট’। কাজ করার ইচ্ছে, উৎসাহ, ক্ষমতা, সবই একসঙ্গে ফুরিয়ে যাবে।
মা-বাবাকে বলছি...
প্রথমত, নিজেরা অর্থ বা প্রাচুর্যের পিছনে ছুটবেন না। তা হলে সন্তানও যদি আপনাদের দেখে ওভাবেই ভাবতে শেখে, তাকে দোষ দেওয়া যায় না। আপনারা অনেকটাই জীবন দেখেছেন। সেই জীবনের গল্প শেয়ার করুন ওদের সঙ্গে। নিজেদের, আশপাশের মানুষদের জীবনের স্ট্রাগ্লের, নানা রঙের অভিজ্ঞতাগুলোর গল্প বলুন। গল্পে গল্পেই বোঝান যে, জীবনে লক্ষ্য স্থির রাখা ভাল, কিন্তু লক্ষ্যটাকেই মোক্ষ বানিয়ে ফেলা উচিত নয়। মরীচিকার পিছনে ছুটলে আখেরে ক্ষতিই হয়। বার্ন আউটের কথা বুঝিয়ে বলুন।
এ কথাও বুঝিয়ে বলুন যে, বিল গেটস বা সুন্দর পিচাইরাও ওই উচ্চতায় পৌঁছবেন ভেবে নিজেদের কর্মজীবন শুরু করেননি। সে রকম ভাবলে ওখানে পৌঁছতেনও না। জীবনে চলার পথ মানুষ চলতে চলতেই ঠিক করে। কারও ক্লোন না হয়ে, নিজে একজন স্বতন্ত্র মানুষ হয়ে ওঠা, আগে থেকে মাইলস্টোন ভেবে নিয়ে সেগুলোকে ছোঁয়ার বদলে নিজের মাইলস্টোন নিজেই বানানো অনেক আনন্দের নয় কি?
যদি মনে হয় বিশেষজ্ঞের পরামর্শ প্রয়োজন, সাহায্য চাইতে দ্বিধা করবেন না। টিন-এজ খুব সংবেদনশীল একটা সময়। সমস্যা যদি আপনাদের হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়, অবিলম্বে যোগাযোগ করুন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে।
আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url