হোলি উৎসব: ২০০০ বছরেরও আগে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন গোকুলে হোলি খেলা চালু করেন
হোলি উৎসব: ২০০০ বছরেরও আগে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন গোকুলে হোলি খেলা চালু করেন
পণ্ডিতেরা বলছেন, ২০০০ বছরেরও আগে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন গোকুলে হোলি খেলা চালু করেন। ইতিহাসে অনেক ইন্দ্রদ্যুম্ন আছেন। কে যে এই ইন্দ্রদ্যুম্ন, তা বলা মুশকিল। ব্রজ অঞ্চলের গল্প অবশ্য অন্য। অত্যাচারী রাজা কংস। সে কৃষ্ণের মামা। কংস মনে করে তার শিশু-ভাগ্নে কৃষ্ণই তার বিপদের কারণ। তাই সে পুতনা রাক্ষসীকে পাঠায়, যাতে তার স্তন্যপানে শিশু কৃষ্ণের মৃত্যু হয়। কিন্তু কৃষ্ণ, সে রাক্ষসীর দুধ এবং রক্ত দুই-ই পান করে ফেলে। ফলে তার গায়ের রং হয়ে ওঠে ঘন নীল। রাক্ষসী পুতনা আগুনে জ্বলে মারা যায়। নীল বর্ণ কৃষ্ণ তার মায়ের কথায় শ্রীরাধার মুখমণ্ডল রঙে রাঙিয়ে দিয়েছিল। রঙিন রঙে রাধা-কৃষ্ণ জুড়ি হয়ে যায়। তাদের এই রঙের খেলাই নাকি হোলি। অনেকে একে ‘ফাগুয়া’ বলেন। এমন উৎসবের কথা ত্রিনিদাদ, টোবাগো, গিয়ানা এমনকি ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জেও শোনা যায়।
ধ্যানে বসেছেন দেবাদিদেব মহাদেব। তাঁর ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য পার্বতী সাহায্য নিলেন প্রেমের দেবতা কামদেব ও তার স্ত্রী রতির। বিরক্ত হলেন শিব। তাঁর তৃতীয় নয়নের চাহনিতে ছাই হয়ে গেলেন কামদেব। পরে শিব-পার্বতীর বিয়ের সময় রতি, কামদেবের জীবন ভিক্ষা করেন। করুণাময় শিব। ফিরে আসেন কামদেব। বসন্ত পঞ্চমী উৎসবের চল্লিশ দিন পরে প্রেমের দেবতা কামদেবের এই ফিরে আসাকে দক্ষিণ ভারতের অনেকেই হোলি উৎসব বলে মানেন। এ ব্যাখ্যা অবশ্য শৈব এবং শাক্ত ধর্মের।
১৪৮৬ সাল। দোল পূর্ণিমা। সন্ধ্যাবেলায় জন্ম নিলেন গোরাচাঁদ। বৈষ্ণবেরা এর নাম দিলেন গৌর পূর্ণিমা। সে দিন সন্ধ্যা-আকাশে চাঁদ উঠলেই, জগন্নাথ মিশ্রের ঘরের রাজরাজেশ্বর শিলাকে স্নান করানোর পর শঙ্খ ঘণ্টা মৃদঙ্গ মন্দিরা বেজে ওঠে নাটমন্দিরে। পর দিন সানাইয়ে রাগ বৃন্দাবনী সারং। গর্ভমন্দিরের বাইরে ভক্ত কণ্ঠে ‘জয় শচীনন্দন জয় গৌরহরি/বিষ্ণুপ্রিয়া প্রাণনাথ নদিয়াবিহারী’। লাল চেলিতে শিশু সাজে মহাপ্রভু। রুপোর থালা বাটি গ্লাসে অন্ন মিষ্টান্ন। ধুপ ধুনো সুগন্ধি আরতি। নবদ্বীপে সেবায়েত গোস্বামীদের চৈতন্যদেবের এই আবির্ভাব তিথি উৎসব এখন আন্তর্জাতিক।
শ্রীকৃষ্ণবিশারদেরা বলেন, শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি রাধা। শ্রীকৃষ্ণ রাধাকে বলেছেন, ‘দেহি পদ পল্লব মুদারম’। ঠাকুমা দিদিমার মুখের গল্পে ‘রা’ শব্দের অর্থ দান। ‘ধা’ শব্দের অর্থ নির্বাণ বা মুক্তি। রাধা তিনিই, যিনি মুক্তি দান করেন। শ্রীকৃষ্ণের আরাধিকার রাধিকা রাধা। কৃষ্ণভজনার জন্যই তাঁর জন্ম। ঠাকুর্দা দাদুর গল্পে, গো অর্থ ইন্দ্রিয় আর পী অর্থ পান করা। তাই ভক্তরা কৃষ্ণরস পান করেন ব্রজভূমি বৃন্দাবনে। ভালবাসার উৎসব হোলি। যা চলে প্রায় ষোলো দিন ধরে। গল্পে আছে এই বসন্ত-পূর্ণিমার দিনেই নাকি শ্রীকৃষ্ণ কেশি নামক অসুরকে বধ করেন। এই অত্যাচারী অসুরবধের পরে কৃষ্ণ তাঁর রক্ত ছিটিয়ে দেন। হয়তো এ-ও এক হোলি উদ্যাপন।
আমাদের দেশে গোয়া অঞ্চলে দেবী দুর্গাকে নিয়ে এক আশ্চর্য গল্প আছে। দেবী দুর্গা মর্ত্য থেকে কৈলাসে ফিরে গিয়ে দৈব শক্তি পান। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে অপমান করে বসেন। ক্রোধান্বিত মহাদেব। তাঁর রুদ্ররোষ থেকে জন্ম নেয় জলন্ধর। এই অসুর জলন্ধর অমরাবতী আক্রমণ করে ইন্দ্রকে বিতাড়িত করে। কিন্তু কৈলাসে এসে পরমেশ্বরী দেবী দুর্গার রূপে আকর্ষিত হলে তার দেহত্যাগ ঘটে। মৃত্যুর আগে তার দেহের শিবের অংশ সদাশিব জ্ঞান পায়। সেই জ্ঞান থেকেই নানা রঙের উদ্ভব। জলন্ধরের শেষ ইচ্ছে অনুসারে তাঁর দেহত্যাগের দিন এই নানা রঙের অনুভূতির উৎসবেই নাকি দোল। এমন গল্প কথাই প্রচলিত।
দোলের চেয়েও অনেক বেশি রহস্যময় আগের রাতের গল্প। বাংলার গ্রাম মফস্সলে ছোটবেলায় দোলের আগের দিন হত ‘ন্যাড়াপোড়া’ যা ছিল অনেকের কাছে বুড়ির ঘর পোড়ানো। বাংলার বাইরে কেউ কেউ একে বলেন ‘হোলিকা দহন’ বা চাঁচর উৎসব। এরও একটি গল্প বেশ মজাদার। ঢুন্ডা নামের রাক্ষসী। শিবের বরে বলীয়ান। ভেড়ার রূপ ধরে সে মানুষের ক্ষতি করে। দোলের আগের দিনই তাকে পোড়ানো হয়। সেই ‘মেড়াপোড়া’ থেকেই নাকি আজকে ‘ন্যাড়াপোড়া’ শব্দের উদ্ভব। আর-এক গল্প প্রচলিত ভাগবত পুরাণের। ব্রহ্মার বরে দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু বিশেষ ভাবে অমর। সে তার বোন হোলিকা-কে নিযুক্ত করে, তার বিষ্ণুভক্ত পুত্র প্রহ্লাদকে আগুনে পুড়িয়ে মারার জন্য। কিন্তু কী আশ্চর্য, সে আগুনে হোলিকা নিজেই পুড়ে যায়। আর বিষ্ণু নৃসিংহ অবতারে হিরণ্যকশিপুকে হত্যা করেন। সেই থেকেই ফাল্গুন মাসের শুক্লা চতুর্দশীতে ‘হোলিকা দহন’ উৎসব। স্কন্দপুরাণের ফাল্গুন মাহাত্ম্য অংশে রয়েছে এ উপাখ্যানের বর্ণনা।
পুরনো কলকাতার দোল ছিল পাঁচ দিনের। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে জার্মানি থেকে আসত রঙ। সে কালের কলকাতার মানুষের পছন্দের রং ছিল লাল সবুজ গাঢ় নীল গোলাপি। বাঁশ তামা পিতলের পিচকারি। সকাল বেলা জলরঙে খেলা। বিকেলে সন্ধেয় আবির। পিচকারির দাম ছিল দু’আনা থেকে দশ আনার মধ্যে। সন্ধেয় বাবুদের বাড়িতে বসত গানের আসর। নিধুবাবুর টপ্পা, যদুভট্টের গান, কবিগান, তরজা, আখড়াই। বৌবাজার থেকে বাগবাজার পর্যন্ত দোলযাত্রার দিন বেরোত নগর-সংকীর্তন। কেউ কেউ গাইত রূপচাঁদ পক্ষীর গান। এ ছাড়াও ছিল কথকতা। দোল উপলক্ষে বাবুদের মজলিশে গেয়েছেন বিখ্যাত বাইজি গওহরজান। শোনা যায় মেঝেয় আবির বিছিয়ে তার উপরে কাপড় ঢেকে হয়েছিল নাচের আয়োজন। নাচ শেষে কাপড় সরিয়ে দেখা গেল আবিরে আঁকা পদ্ম ফুল। গল্প অন্তত তা-ই বলে। পাথুরিয়াঘাটা জমিদার-বাড়িতে গান গেয়েছিলেন আহমেদ খান, অঘোর চক্রবর্তী ও পিয়ারা সাহেব। খাবার বলতে সাদা গোলাপি বাতাসা, রঙিন মঠ ও ফুটকড়াই। পুরনো কলকাতার সেই সব দোল উৎসব বিশেষ ভাবে পালিত হত, সুতানুটি, গোবিন্দপুর এবং বড়বাজারে।
সে কালের কলকাতায় ব্রিটিশ পুলিশ বিভাগ থেকে ডোম সম্প্রদায়ের ঢুলিরা দোলের সময় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রচার চালাত। এখন যা বিবাদী বাগ বা ডালহৌসি, যেখানে এখন মহাকরণ, অতীতে সেখানে ছিল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। রং খেলা শেষ করে এই কলেজের সামনের বড় দিঘিতে এলাকার লোক স্নান করত। জল হয়ে উঠত লাল। তাই এই দিঘির নাম আজও লালদিঘি। লালদিঘির পাশের বাজার সেই কারণেই হয়তো লালবাজার। ইতিহাসের নিয়মে লখনউয়ের নির্বাসিত নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ এলেন মেটিয়াবুরুজে। শোনা যায় তিনিও হোলি খেলতেন এই বসন্ত উৎসবে। লিখতেন নতুন গান।
সাল ১৮৩৭। লাহৌর। বিলাবল বাগান। মহারাজা রঞ্জিত সিংহের সঙ্গে হোলি খেলতে এলেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সেনাপতি স্যর হেনরি। লাহোর দুর্গে একটি দেওয়াল-চিত্রও আঁকিয়েছিলেন রঞ্জিত সিংহ । যেখানে শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের সঙ্গে হোলি খেলছেন। শিখদের সম্প্রদায়ে এই উৎসবের নাম হোলা। গুরু গোবিন্দ সিংহ একে তিন দিনের হোলা মহল্লা উৎসবে পরিণত করেছিলেন। শোনা যায় নেপালের বৌদ্ধ ও জৈনরাও অনেকে এই হোলি উৎসব পালন করেন।
আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url