রবীন্দ্রনাথ তথা কোনও-কোনও বাঙালির কাছে জিশু এক দার্শনিক উপলব্ধি
রবীন্দ্রনাথ তথা কোনও-কোনও বাঙালির কাছে জিশু এক দার্শনিক উপলব্ধি
রবীন্দ্রনাথ তথা কোনও-কোনও বাঙালির কাছে জিশু এক
দার্শনিক উপলব্ধি, বৌদ্ধিক-চর্চার অঙ্গ, ব্যথার আশ্রয়। কী ভাবে? সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে কলকাতায় ঔপনিবেশিক সময়ে জিশুর জন্মদিন, বড়দিন কী ভাবে পালিত হয়েছে, তা একটু ফিরে দেখা যেতে পারে।
আল্পসের গায়ে এক চিলতে জনপদ। ওবেরআমেরগাউ, প্রদেশ ব্যাভেরিয়া। জার্মানি। সপ্তদশ শতক থেকে এই গ্রামে জিশুখ্রিস্টের জীবন নিয়ে নাটক পরিবেশিত হয়, ‘প্যাশন প্লে’ নামে যা পরিচিত। ১৯৩০-এর জুলাই। সে নাটক দেখতে হাজির প্রাচ্যের এক মহাজন। জনশ্রুতি, গ্রামবাসীর অনেকেই সে মহাজনের দিব্যকান্তি চেহারা দেখে, স্বয়ং জিশু ভেবে অভিভাবদন জানালেন। আর সেই মহাজনটি লিখলেন, ‘দ্য বেব’। পরে, যা পরিচিত ‘দ্য চাইল্ড' হিসেবে। সেই মহাজন,
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাতেও লিখলেন ‘শিশুতীর্থ’ ‘জয় হ’ক মানুষের/ ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের।'
রবীন্দ্রনাথ তথা কোনও-কোনও বাঙালির কাছে জিশু এক দার্শনিক উপলব্ধি, বৌদ্ধিক-চর্চার অঙ্গ, ব্যথার আশ্রয়। কী ভাবে? সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে কলকাতায় ঔপনিবেশিক সময়ে জিশুর জন্মদিন, বড়দিন কী ভাবে পালিত হয়েছে, তা একটু ফিরে দেখা যেতে পারে। প্রথমে আসা যাক, বড়দিন-উৎসবের প্রসঙ্গে। মহানগর কলকাতার প্রথম আর্চবিশপ রেজিনাল্ড হেবার। সময়টা ১৮২৩। অবাক চেয়ে দেখেন, ডালহৌসি, চৌরঙ্গির প্রতিটি সাহেবি-বাড়িই বড়দিন উপলক্ষে সেজেছে নতুন রঙে। আর বড়দিনে ঘরদোরের শোভা বাড়িয়েছে দেবদারু গাছের লতাপাতা, ‘ক্রিসমাস ট্রি’।
বস্তুত এর অনেক আগে থেকেই এমন উদ্যাপন শুরু হয়েছে, সূত্রপাতটা সম্ভবত জব চার্নকের আমলেই। তবে অত দূর সময়ে না গিয়ে, আমরা বরং ঢুঁ দিতে পারি মিডিলটন রো-এ। এখন যেখানে ‘লরেটো হাউজ়’, সেখানে একদা ডালপালা মেলে বর্তমান পার্ক স্ট্রিট পর্যন্ত বিস্তৃত এক ছায়া সুনিবিড় বাগানবাড়ি। এটির প্রথম মালিক উইলিয়ম ফ্র্যাঙ্কল্যান্ড নামে এক সাহেব। তিনি সিরাজউদ্দৌল্লার কলকাতা আক্রমণের সময়ে চম্পট দিলেন নৌকায় চড়ে। পরে থাকতে শুরু করেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যর এলাইজ়া ইম্পে। বাগানে হরিণ পোষা বিচারপতি মহোদয়ের শখ। সে সূত্রেই জায়গাটির নাম ডিয়ার পার্ক। আর লোকে না কি বিশ্বাস করে, স্লেজ গাড়ি চড়ে সান্টাক্লজ় এই পার্কেই হাজির হবেন!
সান্টা এসেছিলেন কি না জানা নেই, কিন্তু জাঁকিয়ে বসা বড়দিন উপলক্ষে খানাপিনার দেদার আসর বসে নগর কলকাতায়। সাহেবি পাতে থাকে আপেল, রোজ়মেরি প্রভৃতি দিয়ে সাজানো শুয়োরের মাথা, খ্রিসমাস পাই, শুকনো ফল, প্লাম পুডিং-সহ নানা কিছুর ঢালাও আয়োজন। ব্রিটিশ
ভদ্র ও ভদ্রারা রেড ওয়াইন পান করে গড়াগড়ি খান। বিশ শতকে, বাংলার গভর্নর লর্ড ব্রেবোর্নের ক্রিসমাস ‘বল’ পার্টিতে খরচই হল ৫,২৯৬ টাকা। এ সব জেনেশুনেই বোধহয় সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছেন, ‘প্রভু যীশু জন্ম নিলেন খড় বিচুলির মাঝখানে- আর তার পরব হল শ্যাম্পেনে টার্কিতে!!’ (ময়ূরকণ্ঠী) খানাপিনার সঙ্গে উপহার থাকবে না, তা-ও কী হয়! উপহার যে মনিবকে তৈলমর্দনেরও একটি
উপায়। দেশবাসীর একাংশ ইংরেজ মনিবকে পাঠাতে শুরু করল উপহারের ডালি, ভেট। এর পোশাকি নাম, ‘ডলি।' সাম্প্রতিক সময়ে পার্কস্ট্রিটীয় খানাপিনা, হুল্লোড়, উপহারেই অনেকাংশে সাজানো নগর কলকাতার বড়দিন। তা ভীষণ রঙিন হয়তো। কিন্তু এ সব দেখে বোধহয় গা পিত্তি জ্বলবে দু’জনের, ঈশ্বর গুপ্ত আর রবীন্দ্রনাথের। ঈশ্বর লিখেছেন, ‘খ্রীষ্টের জনম দিন, বড়দিন নাম/ বহুসুখে পরিপূর্ণ, কলিকাতা ধাম/ কেরানী দেওয়ান আদি বড় বড় মেট/ সাহেবের
ঘরে ঘরে পাঠাতেছে ভেট...’। ঘটনাচক্রে, কৌতূহল, ২৫ ডিসেম্বরকে বড়দিন কি ঈশ্বরই প্রথম ব্যবহার বলেছেন? পাশাপাশি, রবীন্দ্রনাথের মতে, অনুষ্ঠানের দ্বারা কর্মকে ‘বিশুদ্ধ’ করা যায় না।
এই সূত্রেই তিনি ‘ভগবদগীতা’ ও জিশুর বাণীকে এক পঙ্ক্তিতে সাজাচ্ছেন। বলছেন, ‘যীশু বললেন, এ তো বড়ো কথা নয়; কী খেলে কী পরলে তা দিয়ে তো লোক শুচি হয় না, অন্তরে সে কী তাই দিয়ে শুচিতার বিচার।' জিশুকে কেন্দ্র করে বাঙালির এমন বৌদ্ধিক-ভাবনাটির শুরু অনেক দিন আগে থেকেই। রামরাম বসু ১৭৮৮-তে লিখেছেন ‘খ্রিস্ট সঙ্গীত'। পরে, রাজা রামমোহন রায়ের ‘পাদরি ও শিষ্য সম্বাদ’, বাইবেলের অংশত অনুবাদ, ‘প্রিসেপ্ট অব জেসাস’ ইত্যাদিও এক অন্য সূত্রের জন্ম দেয়। অধ্যাত্মবাদের ক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ থেকে স্বামী বিবেকানন্দও জিশু নিয়ে সবিশেষ আগ্রহী। উনিশ
শতকে ‘ক্রাইস্ট: ইউরোপ ও এশিয়া’ শীর্ষক ভাষণটি ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের জিশু-চার্চার ফসল। রয়েছে, রেভারেন্ড প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের ‘ওরিয়েন্টাল ক্রাইস্ট-ও'।
তবে বাঙালির বৌদ্ধিক-জীবনকে যিনি আলো দেখান, সেই রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই যেন বাঙালির জিশু-ভাবনার এক অন্য দিগন্তের শুরু।শান্তিনিকেতনের ‘খৃষ্টোৎসব’ জিশুর বাণীকে বোঝারই যেন এক অভিপ্রায়। অভিপ্রায় সেটিকে
প্রাচ্যের ঋষি-বাণীর সঙ্গে মিলিয়ে দেখার। সেই অভিপ্রায় থেকেই কি দশটি লেখা জিশুকে নিয়ে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। রচনাগুলির তারিখটিও চমকপ্রদ, সাতটির ক্ষেত্রে ২৫ ডিসেম্বর! দার্শনিক ভাবনা আন্দোলিত করে পরবর্তী প্রজন্মকেও।
আর সে সূত্রেই বোধহয় জিশু বাংলা কবিতার এক অপূর্ব চিত্রকল্পও। আসে কাজী নজরুল ইসলামের নাম। ‘দারিদ্র’-এ তিনি বলছেন, ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান্।/ তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীস্টের সম্মান/ কন্টক-মুকুট শোভা। পাশাপাশি, ‘বড়দিন’-এ তিনি চিনিয়েছেন, স্বচ্ছল জীবনের পাশে ফল্গুধারার মতো যে জীবন চলে, যে জীবন কলকেতার তলায় বড় হয়, সেই জীবনের সম্পদকে- ‘খিদে’! এই খিদের রাজ্যের বাসিন্দা এক শিশু, যখন সে রাস্তা পারাপার করে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর তাকেই মনে হয় ‘কলকাতার যীশু’। উলঙ্গ সে শিশু এক বারও কি ফালাফালা করে না আমাদের বড়দিনের উৎসবের উল্লাস! উৎসবের এমন আনন্দ আয়োজনে অন্তত এক বার যেন তাই বলতে ইচ্ছে করে, ‘আর ওই দেবতার ছেলে এক ক্রুশ তার বুকে,/ সে শুধু জেনেছে ব্যথা, ক্রুশে শুধু যেই ব্যথা আছে!’ (জীবনানন্দ দাশ)-এই ব্যথার অঙ্গীকারেই জিশুকে শুধু বড়দিনে নয়, বছরভর খুঁজছে বাঙালি, আমি, আপনি, আপনারা, সবাই!
This post is waste all Kolkata information is so good