ব্রজবাসীরা গিরিরাজ গোর্বধনকে উদ্দেশ্য করে অন্নকূট উৎসবের প্রচলন

 ব্রজবাসীরা গিরিরাজ গোর্বধনকে উদ্দেশ্য করে অন্নকূট উৎসবের প্রচলন


উৎসবের সঙ্গে খাদ্যের সম্পর্ক চিরকালীন। কিন্তু খাদ্য নিজেই যখন পূজ্য হয়ে উৎসবের কেন্দ্রে অবস্থান করে, তখন সে উৎসবকে ব্যতিক্রম বলেই মানতে হয়। অন্নকূট, উৎসবের বারোমাস্যায় এমনই এক বিচিত্র উৎসব। যেখানে বিবিধ অন্নব্যঞ্জনই বকলমে দেবতা হয়ে ওঠেন। অন্নব্যঞ্জন পাহাড়ের মতো চূড়া করে সাজিয়ে, তাতে রান্না করা পদ দিয়ে দেবতার মুখের আদলে সাজানো হয় এ দিন।

অন্নকূটের উৎস উত্তর ভারতে। কথিত আছে, দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণ ব্রজবাসীদের ইন্দ্রপুজো বন্ধ করে গিরিরাজ গোর্বধনকে পুজো করতে বলেন। তাঁর যুক্তি ছিল, গোর্বধন পাহাড়ই ব্রজবাসী গোপ সম্প্রদায়ের জীবন-জীবিকার প্রধান আশ্রয়। বিষয়টি জানতে পেরে ক্রুদ্ধ ইন্দ্র ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রে বৃন্দাবনকে ধ্বংস করতে চাইলেন। শ্রীকৃষ্ণ গোর্বধন পাহাড়কে এক আঙুলে করে তুলে ধরে আক্রান্ত ব্রজবাসীদের রক্ষা করেন। এই ঘটনার পর থেকে ব্রজবাসীরা গিরিরাজ গোর্বধনকে উদ্দেশ্য করে অন্নকূট উৎসবের প্রচলন করেন।

অনুমান করা হয়, চৈতন্যদেবের হাতে যখন বৈষ্ণবধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটছে, সেই পর্বে বৃন্দাবনের নানা রীতিনীতি পূর্ব ভারতের ধর্মাচরণের সঙ্গে মিশে যায়। অন্নকূট তেমনই এক উৎসব। পূর্ব ভারতে এই উৎসব উদ্‌যাপনের প্রকরণ খানিকটা বদলে গিয়েছে। অন্ন-সহ নানা সুখাদ্যকে পূজ্য হিসাবে উপস্থাপন করে ভিন্ন ধারার এই উৎসবের ভিন্নতর ব্যাখ্যাও রয়েছে। সংস্কৃতজ্ঞ শুভেন্দুকুমার সিদ্ধান্ত বলেন, “অন্ন বলতে আমরা সাধারণত বুঝি রান্না করা তণ্ডুল। কিন্তু সেটা সঙ্কীর্ণ অর্থে। পাণিনির ব্যাখ্যায় যা কিছু ভক্ষণ করা হয়, তাই অন্ন। অদ্‌ ধাতু থেকে এই শব্দের উৎপত্তি।” তাঁর মতে, এই অন্ন বা খাদ্য হল জীবের প্রাণধারণের প্রধান উপাদান। প্রাণ রক্ষাকারী খাদ্য অপেক্ষা বড় দেবতা আর কে আছে! তাই এই উৎসবের পরিকল্পনা।

নবদ্বীপ মদনমোহন মন্দিরের অন্যতম সেবায়েত নিত্যগোপাল গোস্বামীর ব্যাখ্যা, “অন্নকূটের উৎসে দেখি শ্রীকৃষ্ণ প্রবল প্রাকৃতিক দুর্বিপাকে বিপর্যস্ত মানুষের জন্য আশ্রয় এবং খাদ্যের ব্যবস্থা করছেন। বিপন্ন মানুষের জন্য সর্বাগ্রে খাদ্যের ব্যবস্থা করার ভাবনাটি এই উৎসব থেকেই মেলে।” তাঁর মতে, অন্নকূটে নিয়ম হচ্ছে— যত বেশি রকম পদ নিবেদন করা যায়। যার অর্থ শীতের শুরু থেকে মরসুমি আনাজ খাওয়ার অভ্যাস রপ্ত করিয়ে দেওয়া। যেটা শুরু হয়েছিল ক’দিন আগে চোদ্দো শাক খাওয়ার মধ্যে দিয়ে। খাদ্যগত প্রাণকে সুস্থ-সবল রাখতেই আধ্যাত্মিক ভাবনায় জারিত উৎসব অন্নকূট।

সমাজ বিজ্ঞানের তরুণ গবেষক প্রসেনজিৎ সাহার কথায়, সামাজিক দিক থেকে দেখলে অন্নকূট আদতে খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত উৎসব। তিনি বলেন, “দুর্বিপাকে বিপর্যস্ত বৃন্দাবনের মানুষের জন্য আশ্রয় এবং খাদ্যের ব্যবস্থা করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। এখনও যে কোনও বড় বিপর্যয়ে রাষ্ট্রশক্তি তার প্রজাদের জন্য এই কাজটি আগে করে। ধর্মীয় ভাবনার বাইরে সমাজের দুর্বল মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার একটি ভাবনা সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে রয়ে গিয়েছে অন্নকূট উদ্‌যাপনের মধ্যে।”

এহ বাহ্য। বুধবারের অন্নকূট ঘিরে তুমুল উন্মাদনা নবদ্বীপের মঠে-মন্দিরে। গত দুই বছর করোনার জন্য নিয়মরক্ষার অন্নকূট পালিত হয়ে। এ বার আয়োজন তাই ষোড়শোপচারে। নবদ্বীপের বলদেব মন্দিরের অন্যতম সেবায়েত কিশোরকৃষ্ণ গোস্বামী বলেন, “এ বার আয়োজন অনেক বড়। কিন্তু মঙ্গলবার বিকেলে সূর্যগ্রহণের কারণে অনেক দেরিতে শুরু হল সব কিছু। অন্য বার আগের দিন সকাল থেকে শুরু হয়ে যায় সব কিছু। এ বার সন্ধ্যার পর শুরু হয়েছে। সারা রাত কাজ চলবে।”ধামেশ্বর মহাপ্রভু মন্দির-সহ শহরের সমস্ত মঠ-মন্দিরে অন্নকূটের প্রস্ততি তুঙ্গে। দেবতা এ দিন খাদ্যরূপেন সংস্থিতা!

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url