Gangasagar fair: সব তীর্থ বারবার গঙ্গাসাগর একবার | আজ গঙ্গাসাগর মেলা

 সব তীর্থ বারবার গঙ্গাসাগর একবার | আজ গঙ্গাসাগর মেলা


গঙ্গাসাগরে এক বার:

মেলা চত্বরটি বেশ বড়। হাঁটতে হাঁটতে পুরো এলাকা টহল দেওয়ার পর বোঝা গেল, গোটা ভারত যেন নেমে এসেছে এই মেলা প্রাঙ্গণে। কত ধরনের স্টল। কত ঘোষণা। কত সাধু। মোহন্ত। বাউল। ভবঘুরে। পুণ্যার্থী। যে হয়তো ক্রূর ব্যাপারী, হাত দিয়ে এক টাকা গলে না, পুজো দিতে যাওয়ার সময় সেই মানুষ দু’হাতে পাঁচশো টাকার নোট বিলোতে বিলোতে হাঁটছেন।

ভদ্রমহিলা ফ্যাল ফ্যাল করে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন। শীর্ণ চেহারা। হাতে এক গাছা পিতলের চুড়ি। চুলের রং কাশ ফুলের মতো। তোবড়ানো গাল। ওই হাড় হিম করা ঠান্ডাতেও পরনে শাড়ির উপর একটা পাতলা চাদর। খানিক দূরে কপিলমুনির আশ্রম। সেখান থেকে ভেসে আসছে পুজোর আওয়াজ। চার পাশে হাজার হাজার মানুষ। ঘুরছে। কেনাকাটা করছে। কিছু খাচ্ছে। ভদ্রমহিলার হুঁশ নেই।


ও দিকে পুলিশের অফিসার সমানে হিন্দিতে প্রশ্ন করে চলেছেন, “কী নাম আপনার? কোত্থেকে এসেছেন?”


ভদ্রমহিলা নিরুত্তর। অনেক পরে ভাঙা ভাঙা দেহাতি হিন্দিতে যা জানালেন তা হল, “ছেলে বলেছিল এখানে বসতে। ও পুরি কিনে আনছে। তার পর আর ফেরেনি।”


তখন অল্প বয়স। সাংবাদিকতায় সদ্য হাতেখড়ি হয়েছে। গিয়েছি গঙ্গাসাগর মেলা কভার করতে। মেলায় এসেই পড়েছি প্রবল ঠান্ডার কবলে। ঠান্ডা বলে ঠান্ডা! দুটো মোটা কম্বল চাপিয়েও আগের রাতে হি হি করে কেঁপেছি।


তখন তো এত ইন্টারনেটের বাড়াবাড়ি ছিল না। মোবাইল ফোন সদ্য এসেছে বাজারে। তার একটা ছিল পকেটে। কিন্তু প্রশাসনের বাসে চেপে, ভটভটিতে চড়ে মেলার মাঠে এসে দেখা গেল সাগরে কোনও ফোনের নেটওয়ার্ক নেই। সাংবাদিকদের যে অস্থায়ী থাকার জায়গা, সেখানে একটা টেলিফোন রাখা। পাশে ফ্যাক্স মেশিন। যোগাযোগের মাধ্যম শুধু সেইটুকু। সংবাদপত্র দেখতে হলে যেতে হত জেলা শাসকের অফিসে। 


কুম্ভমেলা কোনও দিন দেখিনি। কিন্তু গঙ্গাসাগর দেখে বুঝেছিলাম, এটা নিশ্চিত ভাবে মিনি কুম্ভমেলা। অন্তত মেজাজ এবং লোক সমাগমের দিক থেকে তো বটেই। বোটে আসতে আসতে চোখে পড়ছিল, প্রচুর মানুষ চলেছেন মেলার দিকে। বেশির ভাগই উত্তর ভারতের গ্রাম থেকে এসেছেন। শুধু বাংলা কিংবা সাগর কেন, নিজের গ্রামের বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে তাঁদের বেশির ভাগের কোনও বিশেষ ধারণা আছে বলে মনে হয়নি। বিরাট দল বেঁধে তাঁরা আসেন। সব দলে এক জন মাতব্বর। তিনিই দলপতি। পথ প্রদর্শক। দলের মধ্যে এক মাত্র ব্যক্তি যিনি হিন্দি ছাড়াও ভাঙা বাংলা জানেন। কলকাতার বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। দরকার হলে পুলিশের সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে কথা বলতে পারেন।

কোনও কারণে যদি কেউ দলছুট হয়ে যায়, তখন দলপতিই যা করার করেন। আর দলছুট মানুষটি? হা হা করে কাঁদা কিংবা অসংলগ্ন কয়েকটি শব্দ ছাড়া তাঁরা বিশেষ কিছুই বলতে পারেন না। তা হলে কেন আসেন? আসেন তীর্থ করতে। তীর্থ মানেই তো পুণ্য করা। কনকনে ঠান্ডায় সকালে বরফগলা জলের মতো ঠান্ডা সমুদ্রের জলে নিজেরা তো স্নান করেনই। অনেকে ছ’মাসের শিশুকেও স্নান করান। উদ্দেশ্য সেই পুণ্যার্জন।

শুধু কি তাই? গঙ্গাসাগর মেলা ঘুরে তেমনটা পুরোপুরি মনে হয়নি। সেই পুণ্যার্জনের পাশাপাশি থাকে কিছু অঙ্ক। জাগতিক চাহিদা। কী রকম? মা কিংবা বাবার বয়স হয়েছে। হয়তো মায়ের হেফাজতে অনেক গয়না। বাবা সব সম্পত্তির মালিক। সেই বৃদ্ধ বাবা-মাকে সাগরে তীর্থ করতে এনে ফেলে রেখে ভিড়ে মিশে যান কিছু ছেলে। স্বেচ্ছাসেবী এবং পুলিশের তৎপরতায় অনেকে ফিরে যেতে পারেন নিজের গ্রামে। অনেকেই পারেন না। আসমুদ্রহিমাচলের বুকে হারিয়ে যান সেই অসহায় বৃদ্ধ কিংবা বৃদ্ধা।

ভাববেন না শুধু এইটুকু। অনেকে নতুন বিয়ে করার জন্যও নিজের স্ত্রীকে সাগরে ছেড়ে যান। হয়তো সেই স্ত্রী পুত্র সন্তানের জন্ম দিতে পারেননি। কিংবা হয়তো স্বামীর কাছে নতুন বিয়ের অফার আছে। আছে দহেজের প্রলোভন। অতএব পুণ্য প্লাস দায় খালাস, দুই-ই করা যাচ্ছে। কিংবা দায় খালাস করে এক ডুব দিয়ে পাপস্খলন।

মেলা চত্বরটি বেশ বড়। হাঁটতে হাঁটতে পুরো এলাকা টহল দেওয়ার পর বোঝা গেল, গোটা ভারত যেন নেমে এসেছে এই মেলা প্রাঙ্গণে। কত ধরনের স্টল। কত ঘোষণা। কত সাধু। মোহন্ত। বাউল। ভবঘুরে। পুণ্যার্থী। যে হয়তো ক্রূর ব্যাপারী, হাত দিয়ে এক টাকা গলে না, পুজো দিতে যাওয়ার সময় সেই মানুষ দু’হাতে পাঁচশো টাকার নোট বিলোতে বিলোতে হাঁটছেন। তখন তিনি রাজা হরিশচন্দ্র। কেউ হয়তো এসেছেন সন্তান কামনায়। অনেক ডাক্তারের চেম্বারে চেম্বারে ঘুরেছেন। করিয়েছেন অনেক ট্রিটমেন্ট। কিছুতেই কিছু হয়নি। শেষে এসে হাজির হয়েছেন সাগরে। যদি মকর সংক্রান্তির স্নানের জেরে ভরে ওঠে তাঁর কোল।

সব যে শুধু অবাঙালি আসেন তা কিন্তু নয়। বহু বাঙালি তীর্থযাত্রীও থাকেন। থাকে প্রশাসনের কড়া নজরদারি। সেই বছর মেলা থেকে বাজেয়াপ্ত হয়েছিল লিটার লিটার চোলাই মদ। শুধু মদ কেন, আরও হাজারটা নেশার বস্তু মেলার আনাচকানাচে পাওয়া যাচ্ছিল। নিজের চোখে দেখেছি।


অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আবার লোককে থাকার জায়গা দেয়। দু’বেলা পেট ভরে খেতে দেয়। গরিব পুণ্যার্থীদের কাছে সেটাও বিরাট প্রাপ্তি। সামান্য কয়েক টাকা সম্বল করে যে মানুষজনেরা সুদূর উত্তর ভারত থেকে পাড়ি দিয়েছেন, তাঁরা কী ভাবেই বা এত খরচ সামলাবেন?


গঙ্গাসাগর মেলায় তাই ভারতবর্ষের ছায়া পড়ে। দেখা যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজনদের। তাঁদের ভক্তি। ধর্মবিশ্বাস। অস্তিত্বের শিকড়। সেই সব মানুষ যাঁদের নিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র গঠিত। যাঁদের না-চিনলে নিজের দেশকে চেনা হয় না। সেই টানে দিন-রাত এক করে মেলায় ঘুরেছিলাম। ব্লটইঙ্ক পেপারের মতো শুষে নিতে চেয়েছিলাম মেলার নির্যাস। সেটাও তো এক ধরনের পুণ্যার্জনই।


আবার বলছি, কুম্ভমেলা দেখিনি। কিন্তু গঙ্গাসাগর যেন ঘরের পাশে সেই কুম্ভের অনুভূতি নিয়েই হাজির হয় প্রতি বছর। সেখানে গেলে, ঘুরলে মন অনেক দূর প্রসারিত হয়। চোখের সামনে তা ভাসতেও থাকা সাগরের জলের মতো। তাই মেলা ভাঙার পর যখন ঘরে ফেরার পালা, তখন মনে মনে বলেছি, আবার আসব। সাংবাদিকতার টানে শুধু নয়, প্রাণের টানে। মানুষ দেখার তাগিদে। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url