Mystery story: 'ভিনগ্রহী টিকলুদাদু' রহস্যে ভরা একটি নতুন গল্প সাহিত্য

'ভিনগ্রহী টিকলুদাদু' রহস্যে ভরা একটি নতুন গল্প সাহিত্য


ভিনগ্রহী টিকলুদাদু - পর্ব ১

দাদুর কাছে টিকলুদাদুর গল্প শোনার জন্য আবদার করেছি আমরা। দাদু তাই শুরু করলেন, “চর্‌রাত চর্‌রাত শব্দ তুলে কে যেন ঠিক আমার পেছন পেছন হাঁটছে! আমি জোরে হাঁটলে তারও গতি বাড়ে। আমি ধীরে চললে সে-ও গতি কমিয়ে দেয়। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে পেছনে কেউ আছে। কিন্তু ঘুরে তাকাতে সাহস পাচ্ছি না। সামনে পেছনে দু’পাশে যে দিকে যদ্দুর চোখ যায়, শুধু ধান খেত। মাঝ দিয়ে চলে গেছে এই মেঠো পথ। একটু আগেও ত্রিসীমানায় কাউকে দেখিনি। তা হলে পেছন থেকে হঠাৎ কে উদয় হল?

“আমার বেশ ভয় করতে লাগল। এমনিতেই এ রাস্তার বদনাম আছে। সন্ধের পরে লোকে এ পথ মাড়ায় না। দিনেও গেলে দলেবলে যায়। শর্টকাট বলে আমি এ রাস্তাটাই নিয়েছিলাম। ফিরছিলাম পাশের গ্রাম সোনারপুরের পিসির বাড়ি থেকে। সে দিন ছিল পয়লা বোশেখ। পিসির বাড়িতে পুজো হয়। সঙ্গে দেদার খাওয়াদাওয়া। আমাদের চার ভাই-বোনের ওখানেই নিমন্ত্রণ। রাতটাও ওখানে কাটিয়ে পর দিন ফেরার কথা। কিন্তু আমার একটা ফুটবল ম্যাচ আছে দেখে আমি দুপুরের খাওয়া সেরে একাই ফিরে আসছিলাম।

“যদিও শেষ দুপুর, কিন্তু রাস্তাঘাট একেবারে নির্জন। চেঁচালেও কেউ শোনার নেই। এক বার ঠিক করলাম দৌড় লাগাব। কিন্তু পর মুহূর্তেই ভাবলাম, আমি দৌড়লে সে-ও যে দৌড়বে না, তার কি ঠিক আছে? সুতরাং সে চিন্তা ছেড়ে অন্য উপায় ভাবতে লাগলাম। এক সময় মনে সাহস এনে আচমকা পিছনে ঘুরলাম আমি। আর কী দেখলাম জানিস?”

“কী দেখলে দাদু?” বিপুল উৎসাহে একযোগে বলে উঠি আমরা।

“দেখি, কান এঁটো করা হাসি নিয়ে তোদের টিকিদাদু দাঁড়িয়ে।”

“টিকিদাদু! তুমি আগে চিনতে টিকিদাদুকে?” জিজ্ঞেস করি আমি।

“আহা, আগে চিনব কী করে? সেই তো প্রথম দেখা। আমার তখন বয়স তেরো কী চোদ্দো, আর টিকলুর বড় জোর দশ-এগারো। ওর দিকে তাকিয়ে আমার সমস্ত ভয় নিমেষে গায়েব। উল্টে বেজায় হাসি পেল। টেকো মাথায় লম্বা টিকিখানা তো আছেই, উপরন্তু বিড়ালের মতো দুটো কান, সবুজ কটা চোখ, দইয়ের হাঁড়ির মতো গোল মুখখানা দেখে হাসি না এসে পারে? যেমন দেখতে অদ্ভুত, তেমনই বিকট তার সাজপোশাক। যেন সং সেজেছে। হাঁটুর ওপরে ধুতি, জমকালো পাঞ্জাবি, গলায় পায়রার ডিমের মতো বড় বড় মুক্তোর মালা, পায়ে বেঢপ আকারের জুতো। ওটারই অমন অদ্ভুত চর্‌রাত চর্‌রাত আওয়াজ হচ্ছে। দেখে হেসেই ফেললাম।

“শুধু আমিই নই, হাসছিল সে-ও। অবশ্য ওর হাসিটা বিনয়ের। ভূতটুত নয় দেখে, এত ক্ষণে আমার মনে স্বস্তির হাওয়া বইছে। রাস্তায় এক জন সঙ্গী পেয়ে বরং খুশিই হলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুই

কে রে?’

“‘আমি? আজ্ঞে আমি ফানুস,’ এক গাল হেসে বলল সে।

“জবাব শুনে তো আমি থ। বলে উঠলাম, ‘ফানুস! সে আবার কী? এটা

তোর নাম?’

“‘না না, নাম নয়। আমি হলাম গিয়ে তোমার মতোই, যাকে বলে ফানুস।’

“‘সে কী! আমি ফানুস হতে যাব কেন?’

“‘তুমি ফানুস নও?’ চোখ গোল

গোল করে বলল টিকলু। তার পরেই

হঠাৎ উল্লসিত হয়ে বলে উঠল, ‘এই তো মনে পড়ে গেছে। তুমি হলে হাঁদা। ওরা বলেছে তুমি ফানুস হলেও তোমাকে

হাঁদা ডাকতে।’

“হাঁদা! শুনে আমার মাথাটা গেল

গরম হয়ে। ভাবলাম, কী সাহস ছেলের! আমাকে বলছে কিনা হাঁদা? আবার কখনও বলছে ফানুস? হয় এ বদ্ধ পাগল, নয় বেজায় বদ ছেলে। রেগে গিয়ে বললাম, ‘অ্যাই? কী যা-তা বলছিস? আমি হাঁদা হতে যাব কেন?’

‘‘বোকা বোকা মুখে তাকাল সে। করুণ স্বরে বলল, ‘ভুল বলেছি বুঝি? তুমি হাঁদা নও? কিন্তু এমনটাই যেন আমায় বলে দিয়েছিল ওরা!’

“‘কারা কী বলে দিয়েছে?’ জানতে

চাই আমি।

“‘আরে, আমাদের লোকেরা গো।’

“‘কী বলেছে? আমি ফানুস? আমি হাঁদা?’ এ বারে আমি সত্যি খেপে গেছি।

“‘না-না, তা নয়। তবে ওই রকমই কিছু। উফ! কিছুতেই মনে আসছে না। কী যেন… কী যেন…’ বলে অস্থির ভাবে মাথার টিকিটা ধরে বার কয়েক নাড়া দিল সে। এর পরেই লাফিয়ে উঠে বলল, ‘পেয়ে গেছি, পেয়ে গেছি। ফানুস না, মানুষ। তুমি মানুষ। আর তুমি হাঁদাও নও, তুমি হলে গিয়ে দাদা। অর্থাৎ সব মিলে তুমি মানুষ দাদা। আর আমিও তোমার মতো মানুষ।’

“শুনে আমি অবাক। এ আবার কেমন কথা? মানুষ আর দাদা শব্দ ভুলে গিয়েছিল? তা ছাড়া, ও যে মানুষ সে তো দেখাই যাচ্ছে। এটা এ ভাবে বলার কী আছে? বিস্ময়টা বেরিয়েই এল মুখ দিয়ে, ‘তুইও মানুষ মানে!’

“‘হ্যাঁ গো আমিও তোমার মতো মানুষ,’ বিগলিত হেসে বলল সে, ‘তোমার মতোই চোখ দিয়ে চাখি, নাক দিয়ে ঢাক বাজাই, কান দিয়ে গান গাই।’

“বুঝলাম, বদ্ধ পাগলের পাল্লায় পড়েছি। নইলে এমন কেউ বলে?

তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে তাকালাম। কিন্তু টিকলু নির্বিকার। বলে চলেছে, ‘আরও আছে, হাত দিয়ে হাঁটি, পেট দিয়ে পেটাই, পা দিয়ে…’

“ওর আজগুবি ভাষণ থামাতে ধমকে উঠলাম, ‘আহ, থাম তো। কী পাগলের মতো বকছিস!’

“‘ঠিক বলিনি বুঝি?’ করুণ মুখে বলল টিকলু।

“‘নাক দিয়ে কেউ ঢাক বাজায়? না

কান দিয়ে গান গায়? উল্টোপাল্টা যা ইচ্ছে বলে চলেছিস?’

“‘কিন্তু আমাকে তো এমনই বলে দিয়েছে…’ বিড়বিড় করল টিকলু, ‘দুচ্ছাই, সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। এক সঙ্গে এত সব শেখালে কি মনে থাকে?’ বলেই হাত দিয়ে টিকিটা নাড়াতে শুরু করল।

“আমি তো ইতিমধ্যে ধরেই নিয়েছি, ওর মাথায় গন্ডগোল। সুতরাং আর জেরায় না গিয়ে বললাম, ‘নাম কী তোর?’

“‘নাম?’

“‘হ্যাঁ, নাম।’

“‘নাম… না-আ-ম… হ্যাঁ-হ্যাঁ, মনে পড়েছে। নাম হল গিয়ে, প্রীতি নিবি।’

“নাম শুনে আমার ভিরমি খাওয়ার জোগাড়।

“‘কী বললি! প্রীতি নিবি? এটা তোর নাম?’

“‘হ্যাঁ… মানে না-না, এটা তো তোমাদের দেশের নাম। তোমাদের দেশের নাম প্রীতি নিবি।’

“‘এই তোর মাথা-টাতা ঠিক আছে তো? আমার দেশের এমন অদ্ভুত নাম হতে যাবে কেন? প্রীতি নিবি কারও নাম হতে পারে? প্রীতি নিবি! হে হে হে! যেন কাউকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে।’

“‘কী বললে নববর্ষ? দাঁড়াও, এই তো সব মনে পড়ে গেল। তোমাদের দেশের নাম প্রীতি নিবি আর গ্রামের নাম নববর্ষ।’

“আমি চোখ কটমট করে তাকালাম। ‘ইয়ার্কি হচ্ছে?’

“টিকলু কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, ‘আবার ভুল বললাম বুঝি? ধুস! সব গোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কী যে হল!’ বলেই আবার টিকিটা ধরে টানাটানি শুরু করল।

“পর ক্ষণেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর চোখ-মুখ। বলল, ‘কিছু মনে কোরো না গো দাদা। খুব ভুল হয়ে গিয়েছিল। এই নাও এখন পুরো মনে পড়ে গিয়েছে। তোমাদের দেশের নাম প্রীতি নিবি না, পৃথিবী। আর গ্রামের নাম নববর্ষ না, ভারতবর্ষ। ওরা তোমাকে নববর্ষের প্রীতি নিবি বলতে বলেছিল কি না। সেটার সঙ্গেই আমি ভারতবর্ষ ও পৃথিবী গুলিয়ে ফেলেছিলাম। কিছু মনে কোরো না হাঁদা।’

“‘আবার হাঁদা!’

“‘ওহ না-না-না, দাদা। হাঁদা

ভুল, দাদা ঠিক,’ নিজের মাথায় চাপড় মেরে নিজেকেই যেন বোঝাতে চেষ্টা

করে ও। তার পর যোগ করে, ‘কী, এ বার ঠিক বললাম তো?’ ওর মুখে এখন বিজয়ীর হাসি।

“‘টিকলুর কথাবার্তা শুনে তখন আমারই সব গুলিয়ে যাওয়ার দশা। ভিতরে-ভিতরে হাসিও পাচ্ছে বেজায়। বললাম, ‘বেশ, পৃথিবী আমার দেশ আর ভারতবর্ষ গ্রামই বটে। তা এ বার নিজের নামখানা বল দেখি।’

“পলকেই টিকলুর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। বলল, ‘আমার নাম একটা বলে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না, জানো?’

“‘অদ্ভুত! নিজের নামও জানিস না?’

“‘জানব কী করে বলো? আমার তো মা-বাবা কেউ নেই। অনাথ আশ্রমে থাকতাম। সেখানে আমাদের সংখ্যা দিয়ে ডাকা হত। এক দিন আমাদের দেশের কয়েক জন তোমাদের দেশ ঘুরে গিয়ে বলল, এ জায়গাটা বেশ ভাল। প্রয়োজনে ভবিষ্যতে এখানে বসতি গড়া যেতে পারে। তা বললেই তো হয় না। তার আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার আছে। এখানকার পরিবেশ, আবহাওয়া, খানাপিনা ইত্যাদিতে আমাদের ওখানকার লোকেরা মানিয়ে নিতে পারবে কি না, জেনে নিতে হবে। সে জন্যে আমাকে এখানে পাঠাল। এ ধরনের পরীক্ষামূলক কাজে অনাথ আশ্রমের ছেলে-মেয়েদেরই পিকনিক না কী যেন বলে, সেটা করা হয়।’

“‘পিকনিক না, গিনিপিগ,’ বললাম আমি।

“‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, ওটাই। তা, আমাকে এখানে রেখে গেল ওরা।’

“টিকলুর কথার মাথামুন্ডু বুঝছিলাম না আমি। আসলে মাথামুন্ডু তো ছিলই না। নিজের নামটাই যে বলতে পারে না, সে অন্য কথা আর কী বলবে? শুধু বুঝলাম, ও অনাথ। ওর কোনও থাকার জায়গা নেই। দেখে মায়া হল। সুতরাং ওকে সঙ্গে নিয়ে চলে এলাম বাড়িতে।

“কিন্তু মনে একটা ভয়ও ছিল। আমার পিসিমা ছিলেন যেমন খিটখিটে, তেমনই খুঁতখুঁতে স্বভাবের। বাল্যবিধবা হয়ে বাবার বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন। বাড়িতে তাঁরই দাপট চলত। পিসিমা ওর বংশপরিচয় না-জেনে ঘরে ঢুকতে দেবেন না, নিশ্চিত ছিলাম। ভয়টা ছিল সেখানেই।

“তবে আমাদের মা ছিলেন জাস্ট উল্টোটা। বড় নরম মনের মানুষ। সুতরাং পিসিমার চোখ এড়িয়ে মাকে সব বুঝিয়ে বলতেই মা বাকিটা ম্যানেজ করে ফেললেন। টিকলুর কাল্পনিক নাম-ধাম-পরিচয় বানিয়ে আমাদের বাড়িতে ওর পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে ফেললেন। ওর লম্বা টিকিটার জন্যে মা ওর নামই রেখে ফেললেন টিকলু। সেই থেকে টিকলু আমাদের বাড়িতে রয়ে গেল।”

এতটুকু বলেই উদাস হয়ে উঠলেন দাদু। টিকিদাদুর কথা ভেবে মনটা ভার হয়ে উঠেছে তাঁর। টিকিদাদুকে তিনি যে ভীষণ ভালবাসতেন। যদিও এ বাড়িতে হেন লোক নেই যে ওই মানুষটাকে ভালবাসত না। শুধু বাড়িতে কেন, টিকিদাদু সারা গ্রামেরই খুব প্রিয় মানুষ ছিল। অবশ্য বার বার মানুষ শব্দটা ব্যবহার করছি ঠিকই, কিন্তু টিকিদাদু যে আমাদের মতো মানুষ ছিল না, এ কথাও আমাদের জানা। এ অঞ্চলের সবাই জানে যে, মৌলিক বাড়িতে এক জন এলিয়েন থাকত। দূর কোনও গ্রহ থেকে আসা এক ভিনগ্রহী।

(ক্রমশ)

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url