বাল্যবিবাহ নিষেধাজ্ঞা (সংশোধনী) বিল ২০২১ (Child Marriage Prohibition (Amendment) Bill 2021)
বাল্যবিবাহ নিষেধাজ্ঞা (সংশোধনী) বিল ২০২১ (Child Marriage Prohibition (Amendment) Bill 2021)
গত বছরের ২০ ডিসেম্বর সংসদে পেশ করা হয় বাল্যবিবাহ নিষেধাজ্ঞা (সংশোধনী) বিল ২০২১। বিলটিতে মেয়েদের ন্যূনতম বিয়ের বয়স ১৮ থেকে বৃদ্ধি করে ২১ করার কথা বলা হয়েছে। সরকারের তরফে, মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স বৃদ্ধির প্রস্তাবের পিছনে মূলত দু’টি যুক্তি দেওয়া হচ্ছে। এক, বাল্যবিবাহ নিষেধাজ্ঞা আইন ২০০৬ বলবৎ থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশে বাল্যবিবাহ অব্যাহত রয়েছে। মেয়েদের ন্যূনতম বিয়ের বয়স বৃদ্ধি করা, সামাজিক এই সমস্যাটির মোকাবিলা করার একটি পন্থা। দুই, মেয়েদের ন্যূনতম বিয়ের বয়স ১৮ থেকে বৃদ্ধি করে ২১ করলে তাঁরা আরও বেশি শিক্ষার সুযোগ পাবেন যা পরবর্তীকালে তাঁদের ক্ষমতায়নে সহায়ক হতে পারে।
আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা পূরণে পদক্ষেপ :
১৯৬২-র ‘কনভেনশন অন কনসেন্ট টু ম্যারেজ, মিনিমাম এজ ফর ম্যারেজ, অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অফ ম্যারেজেস’ (জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত একটি চুক্তি) সংবিধি আইন দ্বারা একটি ন্যূনতম বিয়ের বয়স নির্দিষ্ট করে। এর উদ্দেশ্য ছিল বিয়েতে প্রথাগত, ধর্মীয় এবং উপজাতীয় আইন এবং আচারের গুরুত্ব কমানো এবং বিবাহ নিবন্ধীকরণ বাধ্যতামূলক করা। ভারত এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। কিন্তু ভারত ‘কনভেনশন অন দ্য এলিমিনেশন অফ অল ফর্মস অফ ডিস্ক্রিমিনেশন আগেনস্ট উইমেন’ স্বাক্ষর করেছে যা বাল্যবিবাহ দূর করার কথা উল্লেখ করে। একই সঙ্গে পুরুষ ও মহিলার বিবাহযোগ্য বয়সে অভিন্নতার কথা বলে। আমাদের দেশে ছেলেদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ২১। অতএব, এই কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী হওয়ার দরুণ, ভারতে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়সও ২১ হওয়াটা বাঞ্ছনীয়।
মেয়েদের ন্যূনতম বিয়ের বয়স ১৮ থেকে বৃদ্ধি করে ২১ করলে, ভারতের বিবাহের আইন আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা পূরণে সক্ষম হবে, তা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু মেয়েদের ন্যূনতম বিয়ের বয়স বৃদ্ধি হলে, মেয়েদের কি সত্যিই কোনও উপকার হবে? যে দুটি উদ্দেশ্যর কথা উল্লেখিত হয়েছে প্রস্তাবিত সংশোধনী বিলটিতে, কত দূর পূরণ হবে সেগুলি?
আইন ছিল, আইন ভাঙাও:
ইতিহাসে চোখ রাখলে দেখা যাবে, ১৮ বছরের কম বয়সি মেয়েদের বিয়ে নিষিদ্ধ করার আইনটির অস্তিত্ব বিশ শতকের গোড়া থেকেই কোনও না কোনওভাবে আছে। তা স্বত্ত্বেও, অন্তত ২০০৫ পর্যন্ত বাল্যবিবাহের রমরমা ছিল। ২০০৫-এর পর, বাল্যবিবাহ কিছুটা হ্রাস পেলেও, ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের চতুর্থ রাউন্ডের তথ্য বলছে ২০১৫-১৬-তেও আমাদের দেশে প্রতি ১০ জন মেয়ের মধ্য ৩ জন মেয়ের বাল্যবিবাহ হয়। মজার কথা, ক্রিমিনাল রেকর্ড ঘাঁটলে কিন্তু ভারতে বাল্যবিবাহ আইনের লঙ্ঘন ঘটে না বলেই মনে হবে। কারণ বাল্যবিবাহ সাধারণত ক্রিমিনাল রেকর্ডে নথিভুক্ত হয় না। সমাজ এই অপরাধটিকে অপরাধ হিসেবে মনেই করে না।
যেহেতু আমরা আইন পাশ করে একশো বছরেও ১৮ বছরের কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে বন্ধ করতে পারিনি, কেবল সেই আইনে মেয়েদের ন্যূনতম বিয়ের বয়স ১৮ থেকে ২১ করে অথচ আইনটি কার্যকরী করার পদ্ধতিতে কোনও বদল না এনে, কীভাবে বাল্যবিবাহ রোধ করব? আইন থাকা সত্ত্বেও যে পরিবারগুলি ১৮ বছরের কমে মেয়েদের বিয়ে দেওয়াটা অপরাধ মনে করত না, তাঁরা তো এই আইন সংশোধিত হওয়ার পরও তাই মনে করবে!
শুধু তাই নয়, যে সমস্ত পরিবার ১৮ থেকে ২১ বছরের মধ্যে মেয়েদের বিয়ে দেওয়াটা সঠিক বলে মনে করত (ভারতে প্রায় ৬০ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ থেকে ২১-এর মধ্যে), এই আইন সংশোধনের ফলে তাঁদের অন্তত একটা বড় অংশের মনোভাব পালটানোর কোনও কারণ নেই। ফলত তাঁরাও, আইন সংশোধিত হওয়ার পরও, মেয়েদের বিয়ে ২১ বছরের আগেই দেবে। অতএব, ১৮ থেকে ২১ বছরের মধ্য যাঁদের বিয়ে হবে তাঁদের সংখ্যাটা ধরলে, আইন সংশোধিত হওয়ার পর সমাজে বাল্যবিবাহ তো কমবেই না বরং বাড়বে।
বিয়ের বয়স বৃদ্ধি মানেই নারীর ক্ষমতায়ন?
আগেই বলেছি, সংশোধনী বিলটির প্রথম লক্ষ্য যদি হয় বাল্যবিবাহ বন্ধ করা তাহলে দ্বিতীয় লক্ষ্য মেয়েদের শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং তার মধ্যে দিয়ে মেয়েদের ক্ষমতায়ন। এটা ঠিকই, গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, যে নারীদের বাল্যবিবাহ হয়েছে তাঁদের তুলনায়, যে নারীদের বিয়ে ২১ বছর বয়সের পর হয়েছে তাঁরা বেশি শিক্ষিত। কিন্তু তাঁরা বেশি শিক্ষিত তাঁদের বিবাহ ২১ বছর বয়সের পর হয়েছে বলে নয় মোটেই। তাঁরা বেশি শিক্ষিত কারণ তাঁরা উন্নত পরিবার থেকে এসেছেন, ছোটবেলায় তাঁদের স্কুল যাওয়া বন্ধ করতে হয়নি, তাঁদের বাবা-মায়ের মধ্য অন্তত একজন শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন এবং তাঁরা তফসিলি জাতি ও উপজাতির অন্তর্ভুক্ত নন। অতএব, মেয়েদের ন্যূনতম বিয়ের বয়স ১৮ থেকে বৃদ্ধি করে ২১ করলে যে তাঁদের শিক্ষায় কোনও সদর্থক প্রভাব পড়বে তার কোনও অকাট্য প্রমাণ নেই।
উল্লেখ্য, যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে মেয়েদের ন্যূনতম বিয়ের বয়স বৃদ্ধির ফলে তাঁদের শিক্ষার উন্নতি হবে, তাহলেও এই শিক্ষার উন্নতি তাঁদের ক্ষমতায়নে সহায়ক হবে কিনা আমাদের মতো পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সে নিয়ে কিন্তু সংশয় থেকেই যায়। তার কারণ, গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, মেয়েরা যদি বেশি শিক্ষিত হন, বিশেষ করে শিক্ষায় যদি তাঁরা তাঁদের স্বামীদের সমান হন বা স্বামীদের ছাপিয়ে যান, তাহলে তাঁদের গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়, তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে।
১৮-য় ছাড় সব কিছুতে, বিয়ে ছাড়া:
মেয়েদের ন্যূনতম বিয়ের বয়স বৃদ্ধির বিপক্ষে আরও একটি যুক্তি আছে। আমাদের দেশে ১৮ বছর বয়সের পর প্রায় সমস্ত কিছুর জন্য লাইসেন্স পেয়ে যাওয়া যায়। ১৮ বছরের পরে আমরা ভোট দিতে পারি, ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য দরখাস্ত করতে পারি, ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারি, জমি-বাড়ি বেচা-কেনা করতে পারি, সিনেমা হলে গিয়ে অ্যাডাল্ট ফিল্ম দেখতে পারি। ১৮ বছর আমাদের দেশে ‘এজ অফ কনসেন্ট’-ও বটে। কেবল বিয়ের জন্য ছেলেদের অপেক্ষা করতে হয় ২১ অবধি। এই আইনটি পাশ হয়ে গেলে মেয়েদেরও ২১-এর আগে বিয়ে করা চলবে না।
কিন্তু প্রেমের সম্পর্ক আকছার তৈরি হয় দু’জন ছেলেমেয়ের মধ্যে যাঁদের অন্তত একজনের বয়স ২১-এর কম। যারা এই রকম সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, এরকম হতেই পারে তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করে সংসারও শুরু করতে চান। দু’জনে ২১ না হলেও (এখনকার ডিজিট্যাল পৃথিবীতে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই ছেলেমেয়েরা যথেষ্ট ম্যাচিওরড হয়ে ওঠেন, তাই ১৮-র পর বিয়ের সঠিক সিদ্ধান্ত তাঁরা নিতে পারবেন না, সেটা ভাবার কোনও কারণ নেই)।
এরকম বিয়ে এতদিন পুরোপুরি নিষিদ্ধ ছিল না। অন্তত সেসব ক্ষেত্রে বিয়েতে ছাড় ছিল যেখানে মেয়েটির বয়স ২১-এর কম (অথচ ১৮-র বেশি) এবং ছেলেটির বয়স ২১-এর বেশি। মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ থেকে ২১ করার ফলে যেহেতু এরকম বিয়েও নিষিদ্ধ হবে, সেহেতু আমরা ২১-এর কম বয়সি প্রাপ্তবয়স্ক দু’জন নারী-পুরুষের বিয়ে করার স্বাধীনতা পুরোপুরি খর্ব করে ফেলব না কি? উল্লেখ্য, এর ফলে যদি দেশে ইলোপমেন্টের (পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করা) কেস বৃদ্ধি পায় তাহলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। অতঃকিম? অতএব, সব মিলিয়ে বিচার করলে, মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২১ করলে বাল্যবিবাহ রোধ করতে পারব এবং উচ্চশিক্ষা বা কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের বৃহত্তর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সক্ষম হব, এমনটা ভাবাটা একটু কষ্টকল্পনা।
বাল্যবিবাহ যদি রোধ করতেই হয় তাহলে, আইনের সংশোধন করা নয়, একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকেও আমাদের দেশে মেয়েদের বাল্যবিবাহ কেন হয় সেটা বোঝা জরুরি। বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বাল্যবিবাহের একটি কারণ যদি হয় বস্তাপচা সামাজিক রীতিনীতি, তাহলে দ্বিতীয় কারণ হল বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছনো মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে তাঁদের বাবা-মায়েদের উদ্বেগ। বাল্যবিবাহ রোধ করতে হলে সরকারকে তাই যেমন সামাজিক রীতিনীতি বদলানোর দিকে নজর দিতে হবে, তেমনই কী ভাবে মেয়েদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা যায় সেটা নিয়েও ভাবনাচিন্তা করতে হবে।
মেয়েদের ক্ষমতায়নের জন্য তাঁদের নানা রকম প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষাবৃদ্ধির দিকে নজর তো দিতেই হবে, কিন্তু তারও আগে যেটা প্রয়োজন সেটা হল সামাজিক ও লিঙ্গ-সংক্রান্ত রীতিনীতিতে বদল আনা, পারিবারিক সম্পত্তিতে মেয়েদের ন্যায্য অংশ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা, তাঁদের নিরাপদ কাজের জায়গা প্রদান করা এবং কোনও ক্ষেত্রেই যাতে তাঁদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা না হয় সেটা নিশ্চিত করা।




আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url