মুসলমানদের তৃণমূলের বাক্স থেকে বার হয়ে কংগ্রেসের বাক্সে গিয়ে ঢুকে পড়া?
মুসলমানদের তৃণমূলের বাক্স থেকে বার হয়ে কংগ্রেসের বাক্সে গিয়ে ঢুকে পড়া?
কথায় বলে, গরম ভাতের একটা চাল টিপলে বোঝা যায়, ভাত সেদ্ধ হয়েছে কি না।
কিন্তু মানুষ তো আর ভাত নয়। বরং নিজের এবং পরিবারের মুখে সামান্য ভাতটুকু তুলে দেওয়ার জন্যই মানুষের দিনভর যত দৌড়ঝাঁপ। কেউ ছুটছেন মাঠে, খেত সামলাতে। কেউ আবার একশো দিনের কাজে। কারও হাতে কাগজ-কলম। তিনি যাবেন স্কুলে, পড়াতে।
এমনই কাজের সমাহারে যে যার যোগ্যতা মতো দিনভর খেটে চলেছেন। তাঁরা যেমন বৃত্তিতে আলাদা, তেমনই মেধা-শিক্ষা-পরিবারের নিরিখেও প্রত্যেকে অন্য অন্য মানুষ। একের সঙ্গে আর এক-কে মিলিয়ে ফেলা ঠিক নয়। তাই অঙ্কের মতো এ ক্ষেত্রে যে একের সঙ্গে এক যোগে দুই হবেই, বা বলা ভাল, একের সঙ্গে এক যুক্ত হবেই, তা হলফ করে বলা কঠিন।
এটা সব থেকে ভাল বোঝা যায় ভোটের সময়ে। হাতে গরম উদাহরণ সাগরদিঘির উপনির্বাচন। কত রকমের বিষয়ই না ঘুরে ফিরে এসেছে এই একটি ভোটকে কেন্দ্র করে। কত ধরনের আলোচনা। কেন্দ্রটি সংখ্যালঘু প্রধান। জনসংখ্যার ৬৪ শতাংশ মানুষই মুসলমান। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের সরল অঙ্ককে মাথায় রাখলে এই কেন্দ্রটি তৃণমূলের হাতেই থেকে যাওয়া উচিত ছিল।
কিন্তু রইল না। এর কারণ কি শুধু মুসলমানদের তৃণমূলের বাক্স থেকে বার হয়ে কংগ্রেসের বাক্সে গিয়ে ঢুকে পড়া? তাই যদি হবে, তা হলে হিন্দু প্রধান এলাকাতেও কেন বেশি ভোট পেলেন বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী বাইরন বিশ্বাস? জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশ হিন্দু মানুষ যদি থাকেন সাগরদিঘিতে, তা হলে বিজেপি কেন মোটে ১৪ শতাংশ ভোট পায়?
না, এত সরল অঙ্কে ভোট ভাগ হয় না। অনেক দিন আগে এক সিনিয়র সহকর্মী বলেছিলেন, ভোট মানে পাটিগণিত। তাই এই রাজ্যে বাম ও কংগ্রেস একজোট হলে তৃণমূলের হার অবশ্যম্ভাবী। ২০১৬ সালের সেই ভোটে মানুষ পাটিগণিতের সব ফর্মুলাকে ভোটবাক্সে হারিয়ে দিয়েছিল। একই ভাবে ২০২১ সালে বুথ ফেরত সমীক্ষায় বহু ক্ষেত্রেই বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি।
তা বলে কি সত্যিই একমাত্রিক ভাবে মানুষ ভোট দেয় না কখনও? দেয়। ২০২১ সালেই বেশ কিছু বিধানসভা কেন্দ্র ঘোরার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সেই সব অঞ্চলের সংখ্যালঘু মানুষ মোটামুটি ভাবে মনস্থির করে ফেলেছিলেন যে, তাঁরা কোনও একটি দলকেই বেছে নেবেন। চাকুলিয়ায় আলি ইমরান রমজ বা ভিক্টরকে বহু মানুষ ভালবাসেন। কিন্তু তাঁদেরই অনেককে বলতে শুনেছি, ভিক্টরকে ভোট দিলে যদি বিজেপি জিতে যায়! সুজাপুরের মতো কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটিতে দাঁড়িয়ে ভোটারেরা শুনিয়েছেন ঘর বদলের গল্প।
কিন্তু সেই ফর্মুলায় চললে এ বারে সাগরদিঘি জেতা উচিত ছিল তৃণমূলেরই। হল না। কারণ, ওই যে, মানুষ পাটিগণিতের সংখ্যা আর ফর্মুলা নয়। এক একটি জয় বা হারের পিছনে একাধিক কারণ থাকতেই পারে। কিন্তু সেটা আগে থেকে কোনও ফর্মুলায় ফেলা সম্ভব নয়।
এই সাগরদিঘিতেই দু’বছর আগে মাত্র সাড়ে ১৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিল কংগ্রেস। এ বারে তা বদলে গেল ৪৭ শতাংশে। কারণ: এক, এই ভোটে এনআরসি-র জুজু নেই। দুই, এই ভোট হারলেও রাজ্যে সরকার পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। তিন, ক্রমাগত দুর্নীতি, স্বজনপোষণ এবং বিরোধীদের উপরে ‘অগণন্ত্রিক’ চাপের বিষয়গুলির দিকে নজর রাখলে বলতেই হয়, কোথাও একটা প্রতিবাদের দরকার ছিল। চার, সংখ্যালঘুদেরও মনে হচ্ছিল, তাঁরা তৃণমূলের জয়ে অনুঘটক হলেও ক্ষমতায় এসে শাসকদল তাঁদের জন্য বিশেষ কিছু করেনি। তাঁরা সেই ‘জবাবটিও’ দিতে চেয়েছিলেন।
এতগুলি বিষয়কে এক জায়গায় আনলে যা হয়, সাগরদিঘিতে সেটাই হয়েছে। সেখানে সাধারণ মানুষের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালে ভাত-কাপড়ের সমস্যা, রুজি-রোজগারের সমস্যার কথাই শুনতে পাবেন। আজ যদি শিক্ষক নিয়োগে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির অভিযোগ না থাকত, এবং সেই দুর্নীতির পাঁকে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা নিমজ্জিত না হতেন, যদি একশো দিনের কাজে ঠিকঠাক টাকা পাওয়া যেত, যদি আবাস যোজনার ঘর নিয়ে এত টালবাহানায় পড়তে না হত, তা হলে ফল কোন দিকে যেত, হলফ করে বলা মুশকিল। হয়নি, তাই এই ‘পরিবর্তন’।


আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url